এপ্রিল ১২, ২০২২ ১৫:৪৭ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশাকরছি সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। আমরা হৃদরোগ বা হার্টডিজিজ নিয়ে গত দুই পর্বে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনেছি। আজও এ বিষয়ে কথা বলবেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড.মোহা. তাইফুর রহমান। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার শেষ দিকে হোটেলে রান্নার তেল নিয়ে কথা বলছিলেন। তৈলাক্ত ও চর্বি জাতীয় খাবার বর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি আরোও কিছু কথা বলেছেন। তো চলুন আজকের আলোচনায় গিয়ে সেসব কথা শুনি।

ডা. মো. তাইফুর রহমান রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

ডা. মো. তাইফুর রহমান: ধন্যবাদ আপনাকে।

রেডিও তেহরান: ডা. তাইফুর রহমান, চর্বিতে ক্ষতির কথা আপনি বলেছেন। কোন তেল খাওয়া যাবে এবং কোনটা ক্ষতি হবে সে বিষয়ে আপনি আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্কে আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। যদি আপনি বিষয়টি তুলে ধরেন।

ডা. মো. তাইফুর রহমান: আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেল সেখানে যখন হৃদরোগ খুব বেড়ে গেল তখন তারা দেখতে পেল যে সয়াবিন তেল তারা খাচ্ছে সেটি ফোর্টিফাইড। সয়াবিন তেলের যে ওপেন বর্ন থাকে সেখানে হাউড্রোজেন মেশানো হয়। এটাকে ফোর্টিফিকেশন বলা হয়। আর হাইড্রোজেন মেশানোর কারণে এটি সেচ্যুরেটেড ফ্যাট হয়ে যাচ্ছে। আর সেটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এরপর তারা আইন করে সয়াবিনে হাইড্রোজেন মেশানোর পরিমাণ কমিয়ে দিল। এরপর দেখা গেল যারা সয়াবিন তেল ব্যবহার করছে তাদের মধ্যে রোগের পরিমাণ অনেক কমে গেল এবং সুস্থ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের দেশে সেই আইন নিয়ম কোনোটাই নেই। যে যেভাবে পারে সেভাবে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার করছে, সুন্দর করার জন্য কত কিছু করছে। অনেক দিন প্রিজার্ভ করার জন্য হাইড্রোজেন মেশাচ্ছে বেশি পরিমাণে। আমরাও এটা পছন্দ করি একইসাথে কোনো গবেষণাও এখানে নেই এবং সরকারের পক্ষ থেকে  প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না, আইন করা হচ্ছে না। সে কারণে সয়াবিন তেল খেয়ে কিন্তু আমাদের দেশে হৃদরোগের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ঘানি ভাঙা তেল যদি খাওয়া যেত। আমরা হয়তো কিছুটা উপকৃত হতাম বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: ডা. তাইফুর রহমান, আপনি হৃদরোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়, খাদ্যভ্যাসটা কি হবে হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টে তেলে ভাজা মুখরোচক খাবার খাওয়া হয় সেই তেল আসলে কবেকার তা আমরা জানি না। হয়তো হোটেলের শুরুর দিন থেকে শুরু হয়েছিল এবং এখনও চলছে। এই তেলে হার্টের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। তাই হোটেল রেস্টুরেন্টের তেল বর্জনের পরামর্শ আপনি দিয়েছেন। অথচ আমরা অনেকেই নিয়মিত হোটেলের মুখরোচক খাবার খাই। এবারে খুবই সতর্ক হওয়া উচিত। তো আপনি কোলেস্টেরলের কথাও বললেন। আচ্ছা এই যে নারকেল তেল খাওয়ার কথা অনেকে বলে থাকেন। তারা বলেন এটি অর্গানিক এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। অথচ আপনি বললেন এটি হার্টে জমে যাচ্ছে। তাহলে নারকেল তেল কি খাওয়া যাবে না?

ডা. মো. তাইফুর রহমান: আমি দেখলাম বাংলাদেশের খুব ভালো একজন ডাক্তার উনি সেলিব্রেটি; উনি নারকেল নিয়ে কথা বলেছেন। তবে আমি বলব আসলে নারকেল তেলের পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি আমার জানা নেই। আমি যতটুকু জানি এটা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পামওয়েল সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি সেটিও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসব যে হার্টের জন্য ভালো এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

রেডিও তেহরান: জনাব ডা. মো. তাইফুর রহমান, আজকের সবশেষ প্রশ্নে হৃদরোগের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রসঙ্গে যাব। কারণ আমাদের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করানোর জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য সেভাবে থাকে না। আপনি বলেছিলেন স্ট্রোক হলে যেমন পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, অন্যের ওপর বোঝা হয়ে যেতে পারে ঠিক তেমনি হৃদরোগও ভুগিয়ে থাকে প্রতিটি পরিবারকে। তো হৃদরোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা কিভাবে করা যাবে? এটা কি সব জায়গায় করা সম্ভব?

ডা. মো. তাইফুর রহমান: দেখুন, এটা খুব দুঃখজনক বিষয়। ইসিজি করার পর প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু নাও পাওয়া যেতে পারে। এমনকি হার্ট অ্যাটাকের পরও ইসিজিতে অনেক সময় নর্মাল থাকে। একসময় বলা হতো এনজাইম পরীক্ষার পরই কেবল বোঝা যাবে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না। সেক্ষেত্রে একটা সময় যখন পরীক্ষা নিরীক্ষা সহজ ছিল তখন ইসিজি নর্মাল দেখে হৃদরোগ হয়নি এমন ধারণা করার পর অনেক রোগী মারা গেছে। আমি নিজের চোখে অনেক রোগীকে মরতে দেখেছি। ফলে হার্টঅ্যাটাক হয়েছে কি না সেজন্য প্রথমে আমরা ইসিজি করি। তারপর ইকো করি। ইকোকার্ডিওগ্রাফি সম্পর্কে একটি কথা বলে নিতে চাই। কখনও কখনও এমন দেখা গেছে রোগী এসে বলেন আমি ইসিজি করাব না আমাকে ইকোকার্ডিওগ্রাফি করে দিন এবং দেখুন আমার হার্টের রোগ আছে কি না?

আবার কেউ এসে বলেন, আমাকে হোল বডি চেকাপ করিয়ে দিন এবং একটা এমআরআই করে দিন। তাদেরকে আমি বলি দেখুন, এমআরআই দিয়ে তো প্রস্রাবে ইনফেকশান পাওয়া যাবে না। ধরুন ডায়াবেটিস কত আছে তা কি এমআরআই দিয়ে বোঝা যাবে? যাবে না। আমরা ইকোকার্ডিওগ্রাফি করলে দেখতে পাই হার্টের চেম্বারগুলো মুভ করছে। বাংলায় অলিন্দ বলা হয়। এই অলিন্দ বা চারটে প্রকোষ্টের মধ্যে নিচের দুটো প্রকষ্টে পচন ধরে যদি রক্তনালী ব্লক হয়ে যায়। আর সেটিই হচ্ছে হার্টঅ্যাটাক।

তাদের এই সংকোচন প্রসারণ হয় এবং চাপ দেয় সে বিষয়টি আমরা ইকোতে দেখি। কিন্তু তার রক্তনালীতে ব্লক আছে কি না সেটা কিন্তু ইকোতে বোঝা যাবে না। কিন্তু আমরা ধারণা করে নিতে পারি কোনো একটি অংশ হয়তো সংকুচিত হতে পারছে না। তখন আমরা ধারণা করি রক্তনালীর কোনো একটি অংশে ব্লক থাকতে পারে।

রেডিও তেহরান: ডা. মো. তাইফুর রহমান, ইকো দিয়ে কি তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে হার্টে ব্লক আছে কি না?

ডা. তাইফুর রহমান: না,(Echocardiography)ইকোকার্ডিওগ্রাফি/দিয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না হার্টে ব্লক আছে কি না বা কয়টা রক্তনালীতে ব্লক আছে। ইকো আসলে কি? ইকো হচ্ছে- উচ্চ কম্পাংকের শব্দ তরঙ্গ বা আলট্রা সাউন্ডের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে হৃদপেশীর সঞ্চালন, ভালভ ও প্রকোষ্ঠের বর্তমান অবস্থা এবং হৃদপিন্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করা হয় এ পরীক্ষায়। সাধারণভাবে এটি ইকো নামেও পরিচিত।

এখন করানোর পর ইকো নর্মাল থাকলে পরের স্টেজে আমরা ইটিটি বা (এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট) র কথা ভাবি। এটার অর্থ হচ্ছে ব্যায়াম করলে সে কতটুকু টলারেট করতে পারে তা এই পরীক্ষায় বোঝা যায়। এটাকে অন্য ভাষায় বলা হয়ে থাকে টিএমটি বা ট্রেডমিল টেস্ট। ট্রেডমিলে রোগীকে দৌঁড়াতে দেয়া হয়। তখন আমরা ইসিজি দেখি। তখন আমরা ধারণা করতে পারি ব্লক আছে কি নেই। এর একটা অসুবিধা হচ্ছে কোন রক্তনালীতে ব্লক সেটা বোঝা যায় না।

রেডিও তেহরান: জনাব ডা. তাইফুর রহমান, আপনি যে বললেন কোন রক্তনালীতে ব্লক সেটা বোঝা সম্ভব হয় না। তখন কি করতে হবে? করোনারী এনজিওগ্রামের একটা কথা আমরা শুনে থাকি। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

করোনারি এনজিওগ্রাম

ডা. মো. তাইফুর রহমান: যদি ট্রেডমিল টেস্টে বোঝা না যায় তাহলে পরবর্তী স্টেপ হচ্ছে করোনারি এনজিওগ্রাম। করোনারি এনজিওগ্রাম কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি নয়। করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম হল এমন এক টেকনিক যেখানে এক্স-রে ইমেজিং ব্যবহার করে আপনার হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীগুলোকে, যেগুলোকে করোনারি আর্টারি বলা হয়, দেখা হয়। হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে কি না তা দেখার জন্য এই টেস্ট করা হয়।

যেভাবে এনজিওগ্রাম করা হয়                                     

এনজিওগ্রামের জন্য প্রয়োজন আধুনিক ক্যাথ ল্যাব। ল্যাবে নিয়ে রোগীকে এক্স–রে টেবিলে শুইয়ে আয়োডিন সলিউশন দিয়ে এনজিওগ্রাম করার স্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। প্রয়োগ করা হয় ৫ থেকে ১০ সিসি লোকাল অ্যানেসথেসিয়া। পরীক্ষা শেষে রোগীকে অবজারভেশনে রেখে প্রচুর পানি পান করতে বলা হয়। যাতে রোগীর শরীর থেকে ওপেক ডাই বেরিয়ে যেতে পারে। পায়ে এনজিওগ্রাম করা হলে পা নড়াচড়া করতে নিষেধ করা হয়। এতে পায়ের ফিমোরাল আর্টারি পাংচার এরিয়া থেকে রক্তপাত হতে পারে। তাই রোগীকে এক দিন হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে হাতের রেডিয়াল আর্টারি দিয়ে এনজিওগ্রাম করা হলে হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না।

আর এই করোনারি এনজিওগ্রাম করার পর আমরা নিশ্চিত হতে পারি। কারণ আমরা ডাই দেই। এটি যখন রক্তনালীগুলো রক্তের সাথে প্রবাহিত হতে থাকে তখন কোনো একটি অংশ যদি সঙ্কুচিত থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখানে ব্লক আছে। এই এনজিওগ্রাম আবার দু ধরনের আছে। এই এনজিওগ্রাম আবার দু ধরনের। একটি ক্যাথিডার ঢুকানো হয় না। আর একটি পা অথবা হাত দিয়ে ক্যাথিডার ঢুকিয়ে রক্তনালীর মুখে গিয়ে সেখানে একটি ইনজেক্ট করা হয় এবং জাভা ক্যামেরায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি তোলা হয়।

করোনারি সিটি এনজিওগ্রাম

আর করোনারি সিটি এনজিওগ্রাম হচ্ছে-সিটি স্ক্যান করেও রক্তনালির অবস্থা জানার একটি পরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে, এর নাম করোনারি সিটি এনজিওগ্রাম। ইশকেমিক হার্ট রোগ নির্ণয়ে এটি একটি সর্বাধুনিক নন-ইনভেসিভ (Non-invasive) পরীক্ষা। এটি করার জন্য হাতের শিরা (ধমনী নয়) দিয়ে আয়োডিনযুক্ত কন্ট্রাস্ট ডাই প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।

এখানে ক্যাথেডার ঢুকানো হয় না। তবে ডাই দেয়া হয়। আর ডাই দেয়ার পর একটি সিটি স্ক্যান করা হয়। এতে বোঝা যায় রক্তনালীতে ব্লক আছে কি না। তাহলে ওয়ান অ্যান্ড অনলি টেস্ট হচ্ছে করোনারি সিটি এনজিওগ্রাম যেটা দিয়ে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব যে এখানে ব্লক আছে কি নাই। একটি মানসম্পন্ন স্বচ্ছ এনজিওগ্রাম হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য খুবই জরুরি।

জনাব ডা. তাইফুর রহমান. হৃদরোগ নিয়ে সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্বে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডা.তাইফুর রহমান: ধন্যবাদ আপনাকেও।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! এতক্ষণ হৃদরোগ নিয়ে আলোচনা শুনছিলেন। হৃদরোগের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে অবশ্যই তৈলাক্ত এবং চর্বিজাতীয় খাবার কম খাবেন।নিয়মিত ব্যায়াম করবেন।তো এরইসাথে গুটিয়ে নিচ্ছি স্বাস্থ্যকথার আজকের আসর।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১২

ট্যাগ