এপ্রিল ১২, ২০২২ ১৮:২০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সেমনান প্রদেশের সুন্দর শহর শাহরুদেরই আরেক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব শায়েখ আবুল হাসান খারাকনি'র মাজারের দিকে গিয়েছিলাম। এই মাজারটি শাহরুদ শহরের কাছেই 'খারাকনে নও' নামক গ্রামে অবস্থিত হবার কারণে শায়েখের নামের শেষে খারাকনি যুক্ত হয়েছে।

গার্ম্‌সর শহরের দিকেও গিয়েছিলাম আমরা। আরও দেখেছিলাম কাভির ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত ঐতিহাসিক সিয়হকূহ কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সটি ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর অন্যতম। সিয়হকূহের উত্তর উপত্যকায় একটি সরাইখানার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এই সরাইখানাটি সিয়হকূহ'র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আয়তক্ষেত্র আকারে বানানো হয়েছে এই স্থাপনাটি।

এই ভবন নির্মাণের মূল উপাদান ছিল পাথর। তবে কোনো কোনো অংশে ইটও ব্যবহার করা হয়েছে। এই স্থাপনার বাইরের কাঠামোটি চার কোণা বিশিষ্ট। কয়েকটি টাওয়ার এবং দুটি ফটক রয়েছে-একটি উত্তর অংশে এবং অপরটি দক্ষিণে। এই সরাইখানার পাশে ছয়টি টাওয়ার স্থাপিত হয়েছে। এই ভবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এর বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা।  দুটি নালী একটির ওপর আরেকটি স্থাপন করে বিল্ডিংটিতে পানি বহনের ব্যবস্থা করা হতো। এই দুটি নালির নীচেরটি মাটির পাইপ দিয়ে তৈরি এবং অন্যটি শক্ত সাদা পাথরের স্ল্যাবের মতো। ব্ল্যাক মাউন্টেন বা সিয়হ কূহ'র উপত্যকায় অবস্থিত শাহ ঝর্ণা থেকে এই পানি সরাইখানা ভবনের সামনের বড় বড় পুকুরগুলোতে স্থানান্তর করা হতো। পানি সরবরাহের এই আশ্চর্যজনক ব্যবস্থা দর্শকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং আশ্চর্যজনকও কটে। এই ব্যবস্থাপনা সমকালীন শাসকের অন্যতম প্রধান কীর্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই সরাইখানা ভবনটি সাফাভি শাসনামলে ব্যাপকভাবে মেরামত করা হয়েছিল। তারপর থেকে স্থাপনাটি শাহ-আব্বাসি ভবন নামেই পরিচিতি লাভ করে। ইতোপূর্বে এই স্থাপনার নাম ছিল বাহরাম প্রাসাদ সরাইখানা। এই ভবনের নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক দিন-তারিখের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ভবনের উত্তর গেটের একটি খালি জায়গায় একটা শিলালিপি দেখতে পাওয়া যায়। সেসব বিশ্লেষণ করলে মনে হয় বর্তমান ভবনটি একটি প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ওপর নির্মাণ করা হয়ে থাকতে পারে। সরাইখানা ভবনের চারপাশে যেসব মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন এই ভবনটি সম্ভবত সাফাভি যুগেরও আগেকার মানে তৈমুরি যুগে নির্মাণ করা হয়েছে।

শাহ আব্বাসী সরাইখানা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে লবণ হ্রদ এবং কাভিরে বোজোর্গ মানে বৃহৎ মরুর মাঝামাঝি জায়গায় আরেকটি সরাইখানা রয়েছে। এই সরাইখানাটির নাম হলো এইনুর রাশিদ। এখানে একটি বড় রকমের মিষ্টি পানির ঝরণা বা ফোয়ারা রয়েছে। ফোয়ারাটি সরাইখানা এবং শিকার স্থলের গার্ড পোস্টের মাঝখানে অবস্থিত। এখানকার পানি সরু খাল বা নালার সাাহয্যে প্রাসাদের ভেতরের বাগানে চলে গেছে। ওই বাগানের ফুল-ফলের গাছসহ সকল গাছগাছালির প্রয়োজনীয় পানি এখান থেকেই যেত। নালাগুলোর অস্তিত্ব এখনও উপলব্ধি করার মতো অবশিষ্ট রয়েছে। যদিও সেই প্রাসাদ কিংবা বাগ-বাগিচা এখন মরুভূমির কণ্টকাকীর্ণ উদ্ভিদে ছেয়ে গেছে। এইনুর রাশিদ প্রাসাদের দৈর্ঘ্য ছিয়াশি মিটার আর প্রস্থ সাতচল্লিশ মিটারের মতো। দুটি বড়ো সড়ো উঠোন আছে এই প্রাসাদের। মূল আঙ্গিনাটির দৈর্ঘ্য একান্ন মিটার আর প্রস্থ সাতচল্লিশ মিটার।

শাহ আব্বাসি সরাইখানা থেকে এক কিলোমিটারের মতো দক্ষিণ-পূর্বে সাফাভিভ যুগের আরও একটি নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে। এটি হারামসারা প্রাসাদ নামে পরিচিত। এটি মূলত শাহী বংশের লোকজনের সফরকালীন আবাসের স্থান। এখান থেকে তারা মৃগয়ায় যেত মানে পশু শিকার করতে বিভিন্ন স্থানে যেত। সেই শাহী শিকারীদের আবাসস্থল হলো এই প্রাসাদ। এই প্রাসাদের খাওয়ার পানি সিয়হকূহ পার্বত্য উপত্যকার ফোয়ারাগুলো থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় একটি ক্যানেল বা খালের মাধ্যমে পানি আনা হতো।

হারামসারার দক্ষিণ-পশ্চিমার্ধে একটি বড় রকমের হল এবং উত্তরে দুটি বারান্দা সহ একটি হল রয়েছে। বারান্দার উত্তরে রয়েছে দুটি রুম। প্রথমদিকে এগুলো ছিল না। পরবর্তীকালে বৃদ্ধি করা হয়েছে কক্ষ দুটো। উত্তরদিকের হলগুলো পরিপূর্ণভাবেই নষ্ট হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে ভয়াবহ রকমের ভূমিকম্পে এগুলো নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। যাই হোক এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। সেমনান প্রদেশ সেই প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র ইরানের জন্য লবণ সরবরাহের মূল কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গার্ম্‌সর শহরে সাতাশটি লবণের খনি রয়েছে। ইরানের প্রায় সকল প্রান্তেই এখানকার লবণ যায়। লবণগুহা এবং লবণ টানেল এই এলাকার নামকরা দুটি আকর্ষণীয় নিদর্শন এখন। এগুলো 'কূহ-দাশ্‌ত" খনি হিসেবে পরিচিত। বাইরে থেকে এই এলাকাটি পাহাড়ের মতোই দেখায়। কিন্তু লবণ খুঁড়তে খুঁড়তে এই পাহাড়ে এখন একটি গুহা তৈরি হয়ে গেছে।

গূহামুখে ধূসর রঙের লবণ পাথর দেখতে পাওয়া যায়। তবে গুহা বরাবর অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে দেখা যাবে লবণ পাথরের রঙ ধূসর থেকে পরিবর্তিত হয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে যাচ্ছে। গূহার ভেতরে বারো মিটারের মতো লম্বা লবণের পিলার রয়েছে। এগুলো ভ্রমণকারীদের ভীষণরকম আকৃষ্ট করে। এই চিত্তাকর্ষক ও দর্শনীয় এলাকাটি পরিদর্শন করার সময় সবচেয়ে সুন্দর যে দৃশ্য ভ্রমণকারীদের নজর কাড়ে তা হল বৃষ্টি  বিধৌত খাঁজগুলো। একইভাবে আকৃষ্ট করবে লবণের স্ফটিকগুলো। এগুলো দেখতে অনেকটা ফুলকফির মতো কিংবা ডিমের মতো, তবে স্তরে স্তরে বিভিন্ন রঙে সাজানো।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ