এপ্রিল ২৫, ২০২২ ১৬:০৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। প্রত্যেক আসরের মতো আজও তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই গল্প শুনতে ভালোবাসো! আর সে কারণেই আমরা রংধনুর প্রত্যেক আসরে মজার মজার ও শিক্ষণীয় গল্প ও ঐতিহাসিক নানা ঘটনা  শুনিয়ে থাকি। আজকের আসরেও রয়েছে একটি শিক্ষণীয় গল্প। এটি নেওয়া হয়েছে প্রখ্যাত ইরানি কবি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির মসনবী গ্রন্থ থেকে। গল্পের পর থাকবে মহান আল্লাহর প্রশংসামূলক একটি গান। আর সবশেষে থাকবে একটি কবিতা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।  

আগেকার দিনে এক খলিফা ছিলেন অত্যন্ত দানশীল ও ন্যায়বিচারক। তার দয়া-দাক্ষিণ্য ও বদান্যতা শুধু নিজ দেশের জনগণের জন্য অবারিত ছিল না; বরং দূরের-কাছের অন্য মানুষও তার দানশীলতার ছায়ায় আশ্রয় পেত।

এক রাতে এক বেদুইন মহিলা মনের দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করছিল রাতের অবসরকে নাগালে পেয়ে। কারণ, সারাদিন মহিলাদের পরিশ্রমের অন্ত নেই। ঘরের যাবতীয় কাজ নিজ হাতে আঞ্জাম দিতে হয়। রান্নাবান্না ছাড়াও বাচ্চাদের লালন-পালন, গৃহপালিত পশুর দেখাশোনার দায়িত্বও তাদেরকেই পালন করতে হয়। ফলে সারা দিনমান একটুও ফুরসত থাকে না তাদের হাতে। পুরুষরা থাকে অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পুরো পরিবার সামাল দেওয়ার ঘানি টানতে হয় একা মহিলাদেরই। সংসারের সব কাজ গুছিয়ে শুধু রাতের বেলা একটুখানি সময় পায় তারা। তখন জীবনের সুখ-দুঃখের কথা বলে আপনজনদের কাছে।

এই সুযোগে বেদুইন মহিলা সংসারের নিদারুণ টানাপড়েন, নিঃস্ব-সম্বলহীনতার করুণ কাহিনি শুরু করে স্বামীর সাথে। স্বামীর ঘরের অভাব-অনটনের ফিরিস্তি দিতে তার ভাষা হয়ে যায় কর্কশ। এক পর্যায়ে মহিলা স্বামীকে তিরস্কার করে বলল, আরবদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- যুদ্ধ, লড়াই, লুটতরাজ। কিন্তু তুমি? ওহে আমার স্বামীধন! তোমার তো মুরদ বলতে কিছুই নেই। অভাব-অনটনের মধ্যদিয়ে দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে; অথচ আরবদের এই স্বভাবটুকু তোমার মধ্যে জাগছে না। আরব ঐতিহ্যের কিছুই তোমার নসিবে নেই। সাহস-বীরত্ব বলতে তোমার আছে শুধু ঘরকুনো হয়ে থাকার ব্যারাম। আমাদের ঘরে মেহমান আসে। মেহমানের আতিথেয়তা আরব ঐতিহ্যের অলঙ্কার। অথচ মেহমানের সামনে দেওয়ার মতো তোমার ঘরে কিছুই থাকে না। এরপরও যদি কোনো মেহমান আমাদের ঘরে আসে, বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে তার জামার পকেট হাতড়াতে হয়। তার পকেট চুরি করে ক্ষুধার জ্বালা মেটানো ছাড়া অন্যকোনো উপায় থাকে না আমাদের।

স্ত্রীর বকুনি খেয়ে বেদুইন স্বামী দরদি ভাষায় স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল: এই দুনিয়ার আরাম-আয়েশ একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। এখানকার সুখ-সম্ভোগে মত্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যারা এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে তারাই জীবনে সুখী হয়েছে। দেখো! পশুপাখিরা, জীবনের সুখ-সম্ভোগ নিয়ে এত ভাবে না। জীবন-জীবিকার দুশ্চিন্তা তাদের নেই। কোনো খাবার জমা করে রাখে না। অর্থ-সম্পদ জমানোর সিন্দুকের চিন্তা থেকে তারা মুক্ত। তারা শুধু আজকের দিন নিয়েই ভাবে। তাদের বাকির খাতায় শূন্য থাকে, আগামীকালের ভাবনায় রাত কাটায় না। ফলে তারা সুখী। সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে ফেরে। কেউ তো উপোস থাকে না। জীবিকা নির্বাহের জন্য ওদের ভরসা কার্যকারণ, উপায় ও অবলম্বনের পরিবর্তে যিনি কার্যকারণের মূল নিয়ন্তা তার ওপরে। একেই পরিভাষায় বলা হয় তাওয়াক্কুল। চলো আমরা আল্লাহর ওপর ভরসার জীবন নিয়ে সুখী হই।

স্বামীর মুখে এমন উপদেশ শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল বেদুইন মহিলা। অল্পেতুষ্টির জীবনযাপনের যেসব নসিহত স্বামী খয়রাত করল তার গোষ্ঠীশুদ্ধ উদ্ধার করল।

স্বামী বারবার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ধনাঢ্যতার চেয়ে দারিদ্র্যের উপকার অনেক বেশি। কিন্তু স্ত্রী কোনো যুক্তিই মানতে রাজি নয়। তার সাফ কথা, নিজের মুরদ নেই তাই এসব কথায় আত্মপ্রবঞ্চনায় তোমার দিন যায়। আর যত দুঃখ-যাতনা তা যায় আমার মাথার ওপর দিয়ে।

এভাবে তাদের তর্কাতর্কি চলতে থাকল রাতের দৈর্ঘ্য মেপে মেপে। স্বামী কিছুতেই শান্ত করতে পারল না স্ত্রীকে। শেষ পর্যন্ত হুমকির পথ বেছে নিতে হল তাকে। স্বামী বলল: যদি তুমি এমন দুর্ব্যবহার চালাতে থাক, মুখে যাই আসে তাই বলে যাও, যদি কথার আঘাতে আমার কলিজা খান খান করতে তোমার এতই স্বাদ লাগে, তাহলে আমার সামনে একটি পথই খোলা আছে। তুমি একেবারেই স্বাধীন হয়ে যাও। তোমার মুখে আর লাগামের দরকার হবে না। তোমার সঙ্গে আমার বনিবনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এখন একটাই পথ, আর তা হচ্ছে বিচ্ছেদ। তুমি তালাক নিয়ে নাও, আর আমি চলে যাই নিরুদ্দেশে। সংসারের সবকিছু তোমার থাকবে, আমি হব ভবঘুরে।

স্বামীর কণ্ঠে রাগের আগুন দেখে স্ত্রীর সুর পাল্টে যায়। প্রথমে রাগের অস্ত্র অকার্যকর দেখে আরেকটি অস্ত্র বের করল, যা ধারালো তরবারির চেয়েও সুতীক্ষ্ম। তার এই অস্ত্র আবেগের। মুহূর্তে দু’চোখ বেয়ে বয়ে যায় অশ্রুর সয়লাব। হ্যাঁ, এই সেই অস্ত্র, যা সচরাচর মহিলারা প্রয়োগ করে, আর পুরুষকে তাদের ইচ্ছার সামনে পরাজয় মানতে বাধ্য করে। বেদুইন স্বামী- স্ত্রীর কান্নাবাণে একেবারে কাবু হয়ে যায়। এতক্ষণ যা কিছু বলেছে, তার জন্য অনুতপ্ত হয়। স্বামী বলে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। যা কিছু বলেছি ভুলে যাও। এখন থেকে তোমার কথার বাইরে এককদমও চলব না।

এসব কথায় স্ত্রী শান্ত হয়। দু’জনের মধ্যে পরামর্শ হয় জীবনে সুখী হওয়ার নানা দিক নিয়ে। স্ত্রী পরামর্শ দেয়, সারা জীবন মরুভূমিতে কান্নাকাটি করলেও ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারব না আমরা। কপাল বদলাতে হলে যেভাবেই হোক বাগদাদে খলিফার দরবারে যেতে হবে। তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য সাধনা করতে হবে। সফরের কষ্ট স্বীকার করতে হবে। যেকোনো কৌশলে আমাদের অসহায় অবস্থার প্রতি খলিফার দয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।

স্ত্রীর প্রস্তাব মনঃপূত হয় বেদুইনের। কিন্তু খালি হাতে যে যাওয়া যাবে না, প্রবেশের অনুমতি মিলবে না মহান খলিফার দরবারে। তার দরবারে নেওয়ার মতো উপযুক্ত কি আছে আমাদের ঘরে?

অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্ত্রী বলল: মরুভূমিতে সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হচ্ছে পানি। বৃষ্টির পানি যদি ধরে রাখা যায়, তার চেয়ে মূল্যবান কোনো তোহফার কথা চিন্তা করা যায় না। স্ত্রী বুঝিয়ে বলল: চল একটি মশকে আমরা পানি ভর্তি করি, আর তা নিয়ে তুমি যাও সুদূর বাগদাদে খলিফার মহান দরবারে।

কিন্তু প্রমত্ত দজলা নদী যে বাগদাদের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত আর তাতে থৈ থৈ বিশাল জলরাশি- সে তথ্য স্বামী-স্ত্রী কারও জানা ছিল না।

বেদুইন দম্পতি সিদ্ধান্ত নিল, পানির মশকটি কাথা-কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে নেবে। যাতে মরুর তাপদাহে পানি গরম না হয়। মরুভূমি বা গাঁয়ের বধূরা এভাবেই পানির শীতলতা সংরক্ষণ করে উঞ্চ তাপমাত্রা থেকে। বেদুইন পানির কলসিটি কাঁধে রওনা হয় বাগদাদ অভিমুখে।

মরুভূমির ঝড়-তুফান, চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে এগিয়ে যায় তার যাত্রা। এদিকে স্ত্রী জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে দোয়া মাগে মহান আল্লাহর দরবারে। তার স্বামী যেন নিরাপদে, কোনো চোট-হোঁচট ব্যতিরেকে বাগদাদ পৌঁছতে পারে। স্বামীর পথচলা যেন স্বাচ্ছন্দ্য হয়, কোনো বাধাবিঘ্ন যেন তার অন্তরায় না হয়।

শেষ পর্যন্ত বেদুইন খলিফার দরবারে উপনীত হয়। দরবারের প্রহরী, লোকজন এগিয়ে আসে আগন্তুকের দিকে। তার ক্লান্ত চেহারা, ধুলোমলিন অবয়ব দেখে তারা বুঝে নেয় কী কারণে এসেছে; কী নিয়ে এসেছে। তারা সানন্দে বরণ করে নেয় মরুভূমির মেহমানকে। তার কাঁধের মশক মরুভূমির উপঢৌকন নিয়ে যায় মহামান্য খলিফার সম্মুখে।

খলিফা জেনে নিলেন বেদুইনের দুঃখ-কষ্টের জীবনের অনেক অজানা কাহিনি। তিনি হুকুম দিলেন, বেদুইন পানির যে মশক নিয়ে এসেছে তা স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে ভরে দাও। তার আরও যত অভাব ও চাহিদা আছে পূরণ করে দাও। তাকে একটি নৌকায় করে দজলা নদীর মাঝ দিয়ে তার বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি মশক পেয়ে বেদুইনের আনন্দ আজ বাঁধনহারা। কিন্তু যখন নৌকায় চড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো, দজলার বুকে এসে সে বিস্ময়ে হতবাক। মনে মনে বলে, আমি তো খলিফার দরবারে নিয়ে এসেছিলাম এক মশক পানি। অথচ খলিফার কাছে দেখছি প্রমত্ত দজলা। এই বিশাল জলরাশি যার আছে, তার কাছে আমি এক মশক পানি কীভাবে উপঢৌকন হিসেবে নিয়ে এলাম। এ কেমন লজ্জার কাজ হলো।

মুহূর্তে বেদুইনের চোখ খুলে যায়, স্বচ্ছ নির্মল অগাধ পানিভাণ্ডারের মালিকের কাছে আমি সামান্য এক মশক পানি আনলাম। তা-ই তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। কী আশ্চর্য, এর বদলায় তিনি আমার মশক স্বর্ণে মণিমানিক্যে ভরে দিলেন। সত্যিই এ বাদশাহ কত মহান, কত অগাধ তার ভাণ্ডার। কত মহিয়ান তিনি। বান্দার তুচ্ছ উপহার সানন্দে বরণ করে, বিনিময়ে দেন শতসহস্র গুণ। সত্যিই তার বদান্যতা অসীম অপার।

বন্ধুরা,  অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে 'আল্লাহর দান' শিরোনামের একটি গান। গানের কথা লিখেছেন শাহ মিজান সুর করেছেন ওবায়দুল্লাহ তারেক আর গেয়েছে ঢাকার শিশুশিল্পী জাইমা নূর।

জাইমার চমৎকার কণ্ঠে গানটি শুনলে।  বন্ধুরা, এখন শুনবে কবি  সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা 'দেশলাই কাঠি' শিরোনামে কবিতাটি। এটা আবৃত্তি করেছে ঢাকার সারেগামা একাডেমির সদস্য আরাফাত হোসেন।

আরাফাতের চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। তো বন্ধুরা, দেখতে দেখতে আমাদের সব আয়োজন এক এক করে শেষ হয়ে এলো। তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।