জুলাই ২৩, ২০২২ ১৬:৪০ Asia/Dhaka

সাদ্দাম বাহিনী আগ্রাসন চালানোর পর ইরানের আপামর জনসাধারণ তাদের জাতীয় ও ধর্মীয় পরিচিতি প্রকাশকারী বিপ্লবকে রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আর এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তারা পায় ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মতো একজন দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান নেতাকে। ইমাম এই যুদ্ধের নাম দেন পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ। এই যুদ্ধের আগে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের প্রায় তিন হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। আর ওই বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল জনগণের আত্মত্যাগের দৃঢ় মানসিকতার কারণে; আর সে মানসিকতাও তৈরি করেছিলেন ইমাম খোমেনী (রহ.)। ইমাম শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করে এবং পার্থিব জীবনের চাকচিক্য পায়ে ঠেলে আমেরিকার মতো পরাশক্তি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামোর আওতায় এমন কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় যা অন্যান্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে খুব কমই চোখে পড়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি, বিভিন্ন ইসলামি বিপ্লবী কমিটি, হাউজিং ফাউন্ডেশন, পুনর্গঠন সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন- বাসিজ।  এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে ইমামের উদ্দেশ্য ছিল, সাবেক শাহ সরকারের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্রের জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুতগতিতে জনগণের সমস্যাগুলো সমাধান করা। এগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন- বাসিজ গঠন ছিল একটি অভিনব পদক্ষেপ যা ইরাকের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা যুদ্ধে বিজয়ে নীতি নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে। সারাদেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষ এই বাহিনীতে নিজেদের নাম লেখায় এবং যুদ্ধে যাওয়ার  জন্য প্রস্তুতি ঘোষণা করে।

ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর ১৯৭৯ সালের ২৬ নভেম্বর ইমাম খোমেনী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠনের ঐতিহাসিক নির্দেশ প্রদান করেন।  ওই নির্দেশে তিনি বলেন, “যে দেশটিতে দুই কোটি যুবক রয়েছে সেই দেশের দুই কোটি যুবকের হাতেই অস্ত্র থাকতে হবে এবং এই দুই কোটি যুবকই হবে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্য। আর এরকম একটি দেশের ক্ষতি করার সাহস কেউ পাবে না। ” ইমামের এই নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সারাদেশে তরুণ, যুবক ও কিশোরেরা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে নাম লেখাতে শুরু করেন। এই বাহিনী সর্বপ্রথম যে উল্লেখযোগ্য কাজটি করে তাহলো- বিপ্লব বিরোধী অনেকগুলো ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা নস্যাত করে দেয়। ফলে ইরানে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের মধ্যকার ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী- বাসিজ গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইসলামি বিপ্লবের শত্রুদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ইরাকের সাদ্দাম বাহিনী ইরানের ওপর আগ্রাসন চালায়। বিপ্লব পরবর্তী দেশ গঠন প্রক্রিয়া চলার ওই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে এ ধরনের একটি আগ্রাসন মোকাবিলা করার কোনো প্রস্তুতিই ইরানের ছিল না। ইরানের সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলতে থাকায় এবং আইআরজিসিও একটি নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তাদের পক্ষে শক্তপোক্তভাবে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। কাজেই গণমানুষের সমন্বয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী দেশরক্ষায় আত্মনিয়োগ করে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তেহরান দখলের অভিপ্রায় নিয়ে আগ্রাসন চালানো ইরাকি বাহিনী তাদের অগ্রাভিযানের সামনে খালি হাতে দেশরক্ষায় নিয়োজিত হাজার হাজার মানুষের মুখোমুখি হয়।

ইমাম খোমেনীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সম্পর্কটি ছিল দ্বিপক্ষীয়। এই বাহিনী যেমন ইমামের যেকোনো নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে প্রস্তুত ছিল তেমনি এই বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ইমামের সহানুভূতিও ছিল অভুতপূর্ব। ইমাম খোমেনী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রসঙ্গে বলেন, বাসিজ বা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আমার ঈর্ষা হয়। আল্লাহ যেন আমাকে তাদের সঙ্গী করে কিয়ামত দিবসে উত্থান ঘটান। কারণ, পৃথিবীতে আমার গর্ব করার একটিই জায়গা আর তাহলো আমি একজন বাসিজ বা স্বেচ্ছাসেবী।

ইরাকের বিরুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৯০ ভাগের বেশি যোদ্ধাই ইমাম খোমেনী (রহ.)কে কাছে থেকে দেখেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইমামের যেকোনো নির্দেশ শোনার জন্য তারা পাগলের মতো অপেক্ষা করতেন এবং পাওয়া মাত্র তা বাস্তবায়ন করতেন।

ইরানের স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর এক সদস্যের নাম ছিল মুজতবা সাফদারি। যুদ্ধের সময় এই সুদর্শন কিশোর ছিলেন কলেজের একজন ছাত্র। তিনি নিজের পোশাকের উপর লিখেছিলেন, ইমামের এক ঝলক হাসির বিনিময়ে আমি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে পারি। শেষ পর্যন্ত সাফদারি ইরাকি বাহিনীর হামলায় শহীদ হন এবং তার জামার পকেটে ইমাম খোমেনীর একটি ছবি পাওয়া যায়। এটিই ছিল ইরাক-ইরান যুদ্ধের বাস্তবতা। কঠোর যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধবন্দি হিসেবে ইরাকিদের হাতে আটক থাকার সময় ইরানি যোদ্ধারা ইমামের হাস্যোজ্বল চেহারার কথা স্মরণ করে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতেন।

ইমাম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হওয়ায় ইরানি যোদ্ধারা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ, ইমাম বলেছিলেন, এই প্রস্তাব মেনে নেয়া তার জন্য বিষপানের সমতুল্য। ইমামের এই বক্তব্য মেনে নেয়া ছিল ইরানি যোদ্ধাদের জন্য কষ্টকর। তাদের অনেকে বলে ওঠেন: ইমামের পবিত্র মুখে এই বক্তব্য শোনার চেয়ে শহীদ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো ছিল। ইমাম অনেক দূরদর্শী চিন্তাভাবনা থেকে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন যা সেই সময় বেশিরভাগ মানুষের জন্য বোধগম্য ছিল না।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ