সুখের নীড় - পর্ব ১৭
পরিবার একটি জীবন্ত সত্ত্বার মত। যদি এটি বাইরের উৎপীড়ন ও হুমকি থেকে নিরাপদ থাকে এবং বাইরের নানা প্রভাবক পরিবারের শৈর্য্য-বীর্য ও কার্যকারিতাকে নড়বড়ে করার চেষ্টা না চালায় তাহলে পরিবার পুনর্গঠন করাও কঠিন কোনো কাজ নয়।
পরিবারের মধ্যেই রয়েছে নানা সংকট ও পরিবর্তনকে গঠনমূলক পন্থায় মোকাবেলার নানা উপাদান ও মাধ্যম। ফলে পরিবার নিজেই এর সদস্যদের সহায়তা দেয়ার, নিয়ন্ত্রণ করার ও সুপথ দেখানোর ক্ষমতা রাখে। এসব কাজ করা আসলে পরিবারেরই দায়িত্ব। পরিবার যখন এসব দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় তখন তা হয়ে পড়ে কার্যকর শক্তি লাভের অনুপ্রেরণার উৎস। এমন পরিবারের সদস্যরা তখন হন প্রফুল্ল, অনুধাবন ক্ষমতার অধিকারী, পরিশ্রমী ও আদর্শবাদী। সামাজিক ক্ষেত্রেও তারা হন সমাজ-দরদি, সামাজিক সংহতিকামী, সামাজিক নিরাপত্তার উন্নয়নকারী এবং নতুন প্রজন্মের চাহিদাগুলোকেও তারা সুব্যবস্থাপনার আওতায় আনেন। একটি আদর্শ পরিবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রভাব রাখে। সক্রিয় প্রজন্ম গড়ে তুলে পরিবার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করে।
পরিবারগুলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নানা সংস্কার সাধন করে সমাজের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা বাড়াতে সক্ষম। যেমন, উৎপাদনের সংস্কৃতি ও পণ্য ব্যবহারের সংস্কৃতি, শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। নারী ও পুরুষের অবস্থার আলোকে পরিবার আলোচ্য এই-সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। জীবন যাপনের রীতি ও পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক পরিবারের দুই প্রধান ভিত্তি। এ যেন পাখির দুই ডানার মত। খুব বেশি আবদ্ধ রাখা হলে পাখি মারা যায় এবং খুব মুক্ত রাখা হলে পাখি উড়ে যায়। তাই জীবনকে সুখি করতে ও অর্থপূর্ণ জীবন অব্যাহত রাখতে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও যথাযথ নীতি এবং আচরণ বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
এবারে আমরা যথারীতি ইরানি পরিবারগুলো সম্পর্কে কিছু কথা বলব। ইরানিদের পারিবারিক রীতি বা বিশ্বাস অনুযায়ী বরের বয়স কনের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। তবে তাদের বয়সের ব্যবধান তিন থেকে ৫ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্যই বয়সের এই ব্যবধান থাকা জরুরি। ইরানি পরিবারে নব-বিবাহিত দম্পতির জন্য পৃথক বাসস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর একটি বাড়ি কেনার জন্য সচেষ্ট হন। আর্থিক সঙ্গতি সবার সমান থাকে না। অনেক সময় কিস্তিতে বাড়ি কেনার প্রচলন দেখা যায় নতুন জামাইয়ের পক্ষ হতে। অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি কেনা না হচ্ছে ততক্ষণ নতুন পরিবার বরের পিতার বাড়িতেই থাকেন।
প্রাচীন যুগ থেকেই ইরানি পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা, একতা ও সহমর্মিতার বন্ধন এত শক্তিশালী যে তা নব-দম্পতির পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভবিষ্যত সুখের ধারায় ও নতুন পরিবারের স্থায়ীত্বের পথে কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না।
ইরানিরা যখন জরাথ্রুস্ত ছিল তখনও তাদের ধর্মগ্রন্থে নব-দম্পতিদের সৎ কাজে প্রতিযোগী হতে পরামর্শ দেয়া হত।
ইরানি সংস্কৃতির আলোকে দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করার অনেক চালিকাশক্তি রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে উন্নত আচরণ, সহৃদয় মনোভাব, সংসারের সঠিক পরিচালনা, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ মেনে চলা ইত্যাদি। দাম্পত্য জীবনে সুখের জন্য আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নম্রতা, দায়িত্বশীলতা, পারস্পরিক কৃতজ্ঞতা, পরস্পরের গোপনীয়তা রক্ষা, সততা ও ধৈর্য ইত্যাদি গুণ বেশ জরুরি।
সঠিক ব্যবস্থাপনা ও উত্তম ব্যবহার সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমাজকে সজীব, সচল বা প্রাণবন্ত রাখার জন্যও এ দুটি বিষয় জরুরি। উইল ডুরান্টের ভাষায় সংসারকে আধুনিক জীবনের যান্ত্রিকতা ও কৃত্রিমতা থেকে রক্ষা করতে হবে। তার মতে এই ক্ষেত্রটি কূটিল রাজনীতি বা শিল্পের ময়দান নয়। এখানে দরকার পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মানবিকতা ও সহমর্মিতা।
পরিবারের ছায়ায় স্বামী ও স্ত্রীর ভালবাসা বা গভীর অনুরাগ গভীরতর হওয়া উচিত। পারস্পরিক দয়া ও প্রেম-অনুভূতি যখন ক্রমেই গাঢ় হতে থাকবে তখন সেটাই হয়ে পড়ে সংসারের সব কর্মপ্রচেষ্টার সবচেয়ে ভালো প্রেরণা। এমনকি অগভীর বা কেবল মৌখিক ভালোবাসাও মানুষকে করে তোলে উদ্যমী ও আশাবাদী। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সদাচরণ ইসলামের কাঙ্ক্ষিত জীবনাচার তথা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম যা পারিবারিক বন্ধনকে করে শক্তিশালী।
ইরানি পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন থেকে পারস্পরিক অধিকারকে মান্য করার ও দায়িত্বশীল হওয়ার চেষ্টা করেন। ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন ছাড়াও স্ত্রীকে মানসিকভাবে খুশি রাখা স্বামীর দায়িত্ব। অন্যদিকে স্ত্রীকেও নির্ধারিত সাংসারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বামীকে মানসিক দিক থেকেও প্রফুল্ল রাখার জন্য সক্রিয় হতে হবে।
আধুনিক যুগের জীবনযাত্রা, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ধাক্কা ইরানি পরিবারগুলোকেও স্পর্শ করেছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের শিকার হচ্ছে। ভোগবাদী জীবনধারা অর্থনৈতিক সংকটকে যখন প্রকট করে তোলে তখন অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আবার অনেকেই এইসব সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে নানা কৌশল ও কর্মপন্থা উদ্ভাবন করছেন। অনেকেই আধুনিক জীবন-রীতির সঙ্গে কিছুটা আপোষ ও কিছুটা প্রতিরোধ এ দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে ইসলামী ও ইরানি সাংস্কৃতিক ধারাকে যতটা সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। বয়স্ক বা মুরব্বি শ্রেণীর অনেকেই অর্থনৈতিক সংকটের শিকার নব-দম্পতিকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে নিজ পরিবারের সন্তানদের ওপর কার্যকর প্রভাব অব্যাহত রাখছেন।
পবিত্র কুরআনে অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই নিজের ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি নেয়া ও ঘরের অধিবাসীকে সালাম দেয়া জরুরি। (সুরা নুর-২৭ দ্র) সালামের এই বিধান ঘরের সীমানাকে পবিত্র হিসেবে তুলে ধরে। সালাম পারস্পরিক সম্পর্ককে করে সুস্থ, উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ এবং এটি খোদায়ি নির্দেশ হিসেবে আল্লাহকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। পরিবারগুলো সুস্থ ও নিরাপদ হলে সমাজও হবে সুস্থ ও নিরাপদ। কাউকে সালাম করার অর্থ এটাও তুলে ধরা যে আপনি আমার দিক থেকে নিরাপদ এবং আমি পারস্পরিক সম্মান, সহমর্মিতা ও হৃদ্যতার নীতিতে বিশ্বাসী।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।