আগস্ট ১৬, ২০২২ ১৮:০৫ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা তূরের সংক্ষিপ্ত তাফসির। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় পরকাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জগতে সৎকর্মপরায়ণ ও গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ১৩ থেকে ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

یَوْمَ یُدَعُّونَ إِلَى نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا ﴿١٣﴾ هَذِهِ النَّارُ الَّتِی کُنْتُمْ بِهَا تُکَذِّبُونَ ﴿١٤﴾ أَفَسِحْرٌ هَذَا أَمْ أَنْتُمْ لا تُبْصِرُونَ ﴿١٥﴾ اصْلَوْهَا فَاصْبِرُوا أَوْ لا تَصْبِرُوا سَوَاءٌ عَلَیْکُمْ إِنَّمَا تُجْزَوْنَ مَا کُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿١٦﴾

“যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।” (৫২:১৩)

“[তাদেরকে বলা হবে] এটা হল [জাহান্নামের] সেই আগুন যাকে তোমরা মিথ্যে প্রতিপন্ন করেছিলে।” (৫২:১৪)

“তবে কি [এই আজাবও] জাদু? না কি তোমরা [ঠিকমতো] দেখতে পাচ্ছ না?” (৫২:১৫)

“তোমরা এতে প্রবেশ করো এবং দগ্ধ হও! অতঃপর তোমরা ধৈর্য ধারণ করো অথবা ধৈর্য ধারণ না করো উভয়ই তোমাদের জন্য সমান। তোমরা যা করতে শুধুমাত্র তারই প্রতিফল তোমাদেরকে দেয়া হচ্ছে।” (৫২:১৬)

যুগে যুগে নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণকারীদের একটি অভিন্ন কৌশল ছিল এই যে, তারা নবীদের পক্ষ দেখে দেখানো মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শনকে যাদু ও ভেল্কিবাজি বলে অভিহিত করত। তারা বলত, এ ব্যক্তি অর্থাৎ নবী আমাদেরকে যাদু করেছে এবং আমাদের চোখের সামনে পর্দা ফেলে দিয়েছে। ফলে আমরা আসল জিনিস দেখতে পাচ্ছি না। তাদের এই ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের জবাবে এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: যখন এসব কাফির জাহান্নামের আগুন স্বচক্ষে দেখতে পাবে এবং এর দাহ্যশক্তি অনুভব করবে তখন তাদেরকে বলা হবে: এটিও কি তাহলে যাদু নাকি তোমাদের চোখ ভুল করে আগুন দেখতে পাচ্ছে?

নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণকারী কাফিররা পার্থিব জীবনে আরেকটি কথা বলত। তারা নবীদের বলত: তুমি আমাদের কিয়ামত সম্পর্ক সতর্ক করো বা না করো তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা তোমার কথা শুনব না। তাদের এই বক্তব্যের জবাবে এখানে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন এ ধরনের কাফিরদের বলা হবে: তোমরা আজ আগুনে দগ্ধ হওয়ার সময় ধৈর্য ধারণ করো অথবা আর্তনাদ করো তাতে আল্লাহর  কিছু যায় আসে না। এই আগুন থেকে তোমাদের আর কোনোদিন মুক্তি মিলবে না।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- সত্যের মোকাবিলায় হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমির শাস্তি অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ হয়।

২- কিয়ামতের দিনে বিচার হবে ন্যায়বিচার। সেদিন মানুষ তার কৃতকর্মের সঠিক প্রতিদান পাবে।

৩- ধর্মীয় পবিত্র মূল্যবোধগুলো নিয়ে ঠাট্টা ও কটাক্ষ করলে কিয়ামতের দিন একইরকম ঠাট্টা ও অপমানের শিকার হতে হবে।

সূরা তূরের ১৭ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّ الْمُتَّقِینَ فِی جَنَّاتٍ وَنَعِیمٍ ﴿١٧﴾ فَاکِهِینَ بِمَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ وَوَقَاهُمْ رَبُّهُمْ عَذَابَ الْجَحِیمِ ﴿١٨﴾ کُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِیئًا بِمَا کُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿١٩﴾

“নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাতে ও অফুরন্ত আরাম-আয়েশে।” (৫২:১৭)

“তাদের রব তাদেরকে যা দিয়েছেন তারা তা সানন্দে উপভোগ করবে এবং তাদের রব তাদেরকে রক্ষা করেছেন জাহান্নামের শাস্তি থেকে।” (৫২:১৮)

“[তাদেরকে বলা হবে] তোমরা যে আমল করতে তার প্রতিদান স্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সাথে পানাহার করতে থাকো!” (৫২:১৯)

পবিত্র কুরআনের শিক্ষার একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, এখানে ভয় ও আশা এবং সতর্কতা ও সুসংবাদ পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয় এবং অনর্থক মিথ্যা আশাও না করে। আগের আয়াতগুলোতে জাহান্নামীদের শাস্তি বর্ণনা করার পরপরই এই তিন আয়াতে জান্নাতিদের অফুরন্ত নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: জান্নাতিরা সেদিন দুই কারণে আনন্দে মাতোয়ারা হবে। প্রথমত, তারা অফুরন্ত নেয়ামত পেয়ে ধন্য হবে এবং দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাদের অপরাধগুলো ক্ষমা করে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- জান্নাতের চাবি হচ্ছে তাকওয়া, পবিত্রতা ও পবিত্র জীবন। যদি তাকওয়া বা খোদাভীতি না থাকে তাহলে শুধুমাত্র ঈমান দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

২- পার্থিব জীবনে যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে আল্লাহ তায়ালা পরকালে তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেবেন।

৩- জান্নাত হচ্ছে পার্থিব জীবনের নেক আমলের পুরস্কার। তাকওয়া ছাড়া নেক আমল সম্ভব নয়। আর শুধু শুধু কাউকে জান্নাত দেয়া হবে না। শেখ সাদী যেমনটি বলেছেন:

“কষ্ট ছাড়া যেমন মেলে না গুপ্তধন, যে পরিশ্রম করেছে তারই প্রাপ্য প্রতিদান।”

সূরা তূরের ২০ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

مُتَّکِئِینَ عَلَى سُرُرٍ مَصْفُوفَةٍ وَزَوَّجْنَاهُمْ بِحُورٍ عِینٍ ﴿٢٠﴾ وَالَّذِینَ آمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّیَّتُهُمْ بِإِیمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَیْءٍ کُلُّ امْرِئٍ بِمَا کَسَبَ رَهِینٌ ﴿٢١﴾

“তারা বসবে শ্রেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে; আর আমরা তাদের মিলন ঘটাব ডাগর চোখবিশিষ্টা হূরদের সঙ্গে।”  (৫২:২০)

আর যারা ঈমান আনে, আর তাদের সন্তান-সন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, আমরা তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমরা একটুও কমাবো না; [হ্যা] প্ৰত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী।” (৫২:২১)

এই দুই আয়াতে জান্নাতিদের প্রতি আল্লাহর আরো কিছু অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা বলা হচ্ছে: জান্নাতে তারা নেককার ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ লাভ করবে এবং আনন্দময় পরিবেশ উপভোগ করবে। তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ও পরমাসুন্দরী স্ত্রীর ব্যবস্থা করবেন। এমনকি যেসব ঈমানদার নারী ও পুরুষ পার্থিব জীবনে পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী ছিল তারা জান্নাতেও পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। ঈমানদার সন্তানদেরও আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে ঈমানদার পিতামাতার সঙ্গে মিলিত হওয়ার তৌফিক দেবেন যাতে একটি পরিবার পূর্ণতা পায় এবং তাদের মনে কোনো কষ্ট না থাকে। সেদিন আল্লাহ তায়ালা ঈমানদার সন্তানদের আমলে ঘাটতি থাকলেও তা পূরণ করে পিতামাতার মতো উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। আর এজন্য পিতামাতার কর্মফল মোটেও হ্রাস করা হবে না।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- জান্নাতের জীবনেও পবিত্রতার মাণদণ্ড বজায় থাকবে। সেখানেও নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হবে বিবাহের মাধ্যমে এবং সে বিবাহ আল্লাহ তায়ালা নিজে দিয়ে দেবেন। কোনো ধরনের বল্গাহীন যৌনতা সেখানে থাকবে না।

২- পার্থিব জীবনে যারা বেগানা নারী ও বেগানা পুরুষ থেকে দৃষ্টি বাঁচিয়ে রেখেছে কিয়ামতের দিন তাদেরকে পবিত্র সঙ্গী বা সঙ্গিনী দিয়ে পরিতৃপ্ত করা হবে।

৩- ইসলামে পরিবার গঠনের ভিত্তি হচ্ছে ঈমান। কাজেই জান্নাতেও ঈমানদার স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিরা একসঙ্গে থাকার সৌভাগ্য লাভ করবে।

৪- পরিবার গঠন ও সন্তান ধারন মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। জান্নাতে মানুষের এই প্রয়োজনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ