আগস্ট ২৭, ২০২২ ১৮:৩৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। রংধনুর আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকছে বিদেশি গল্প অবলম্বনে কয়েকটি শিক্ষণীয় গল্প। গল্পের পর থাকবে একটি কবিতা ও একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্প শোনা যাক।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু' এই প্রবাদটি শুনেছ। এই প্রবাদটি মধ্যেই কিন্তু লোভের ফল ও এর পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও অনেক মানুষ লোভ-লালসার কাছে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমরা লোভ থেকে বিরত থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে।'

বন্ধুরা, তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে- লোভ আসলে কী? আজকের আসরের প্রথম গল্পটি এ সম্পর্কেই।

(লোভ কাকে বলে) 

এক শিক্ষকের কাছে ছাত্র জানতে চাইল, ‘স্যার, লোভ কী?’

শিক্ষক বললেন, ‘এর জবাব পেতে হলে আমাদের স্কুলের পেছনের চকোলেট কারখানার ভেতরে যাও। তোমার সবচেয়ে পছন্দের একটি চকোলেট বেছে নাও সেখান থেকে। কিন্তু একটাই শর্ত- তুমি চকোলেটের সারি বরাবর যাবে। শুধু সামনে যাওয়ার সময় তোমার পছন্দের চকোলেটটি নিতে পারবে। ফেরার সময় তা আর নিতে পারবে না।’

ছাত্রটি চকোলেট কারখানায় গেল। সারি বরাবর যাওয়ার সময় সুন্দর মোড়কে একটা চকোলেট দেখল। তখনই সেটা পছন্দ হল তার। কিন্তু সামনে আর একটা বড় চকোলেট দেখে চমকিত হল। কাজেই সে এগিয়ে গেল সেদিকে। কিন্তু সামনে আরও একটা চমৎকার চকোলেট দেখল। আবার এগিয়ে গেল। এভাবে আরও বড় আরও সুন্দর চকোলেটের আশায় সোজা সারির সামনের দিকে চলতে থাকল।

ছাত্রটি যখন সারির শেষ প্রান্তে পৌঁছল তখন আর আগের মতো কোনো বড় সুন্দর চকোলেট দেখতে পেল না। বুঝতে পারল, আগেরটা না নিয়ে তা হাতছাড়া করে ফেলেছে।

অবশেষে সে খালি হাতে ফিরে এলো শিক্ষকের কাছে। চকোলেট কারখানায় কী করেছে সব খুলে বলল।

শিক্ষক বললেন, ‘তুমি প্রথমে একটি চকোলেট খুব পছন্দ করেছিলে কিন্তু তা না নিয়ে তখনও খুঁজছিলে আরও বড় একটি। তারপর তুমি বুঝতে পরলে বড়র আশা করতে গিয়ে তোমার পছন্দের চকোলেটটিই হারিয়েছ। সেটাই হল লোভ।

বন্ধুরা, এই গল্পের নীতিকথা হলো- লোভের কারণে আমরা আমাদের জীবনে অনেক ভালো জিনিস হারিয়ে ফেলি। তাই আমাদের উচিত লোভ থেকে দূরে থাকা।

(স্বর্ণমুদ্রা ও লোভী লোক)

অনেক দিন আগের কথা। এক ছিল লোভী লোক। অন্যের জিনিসে ভাগ বসানোর সুযোগ খুঁজত সবসময়। কিন্তু নিজের এক আনাও অন্য কাউকে দিত না। এমনই স্বার্থপর মানুষ সে।

একদিন লোকটি রাস্তায় ত্রিশটি স্বর্ণমুদ্রা হারিয়ে ফেলল। স্বর্ণমুদ্রা হারানোর কথা শুনলেন তার এক বন্ধু। তিনি ছিলেন খুব দয়ালু। ঘটনাক্রমে তার মেয়ে ওই ত্রিশটি স্বর্ণমুদ্রা কুড়িয়ে পেল। বাড়ি ফিরে সেই কথা বাবাকে জানাল মেয়েটি। দয়ালু লোকটি ভাবলেন, এটা নিশ্চয় তার বন্ধুর হারিয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণমুদ্রা। তাই মুদ্রাগুলো ফিরিয়ে দিতে তিনি লোকটির কাছে গেলেন।

লোভী-স্বার্থপর বন্ধুটি যখন শুনল তার মেয়ে ওই মুদ্রা কুড়িয়ে পেয়েছে তখন সে বলল, ‘আমার মোট চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তোমার মেয়ে নিশ্চয় এখান থেকে দশটি সরিয়ে রেখেছে। আমাকে তোমার চল্লিশটি মুদ্রাই দিতে হবে।’

বন্ধুর এ কথা শুনে দয়ালু লোকটি রেগে গেলেন। তবু মুদ্রাগুলো সেখানে রেখে চলে এলেন বাড়িতে। কিন্তু লোভী বন্ধুটি তাকে ছাড়তে চাইল না। আরও দশটি স্বর্ণমুদ্রা আদায় করার ফন্দি আঁটল। সে নালিশ জানাল আদালতে।

খ) বিচারক সেই বাবা ও তার মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। তারা এলে বিচারক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি সে কতটি মুদ্রা পেয়েছিল। ত্রিশটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার কথা জানাল মেয়েটি। বিচারক আবার লোভী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কতটি মুদ্রা হারিয়েছিল। লোকটি জবাব দিল, ‘হুজুর, মোট চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা।’

বিচারক বললেন:‘তাহলে মেয়েটির কুড়িয়ে পাওয়া স্বর্ণমুদ্রাগুলো তোমার নয়। কারণ মেয়েটি পেয়েছে ত্রিশটি মুদ্রা। কিন্তু তুমি হারিয়েছ চল্লিশটি।’ এ কথা বলে বিচারক মুদ্রাগুলো মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বললেন। এও জানিয়ে দিলেন, যদি কেউ এই ত্রিশটি হারানো মুদ্রা দাবি করে তবে তাকে আবার ডেকে পাঠাবেন তিনি।

এবার বিচারক লোভী লোকটিকে বললেন, ‘যদি কেউ খবর দেয় সে চল্লিশটি স্বর্ণমুদ্রা কুড়িয়ে পেয়েছে তবে তোমাকে ডেকে পাঠানো হবে।’

লোভী লোকটি বিপদ বুঝতে পারল। দশটি স্বর্ণমুদ্রা আদায় করতে গিয়ে নিজের ত্রিশটিই হারাতে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল, সে মিথ্যা বলেছে। আসলে তার ত্রিশটি স্বর্ণমুদ্রাই হারিয়েছে। তাই তাকে সেগুলো ফিরিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু বিচারক তার কোনো কথাই শুনলেন না।

এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মিথ্যা বলে অন্যের জিনিস হাতাতে গেলে নিজেরটাই খোয়া যেতে পারে।

(বুড়ো কারিগর)

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, দৈনন্দিন জীবনে অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অপরিসীম। কখনো কখনো এমন কিছু মানুষের দরকার হ, যাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিপদ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে এ সম্পর্কেই একটি গল্প।

একবার বিরাট এক জাহাজ যান্ত্রিক গোলযোগে নষ্ট হয়ে পড়ে রইল। মেরামতের জন্য মালিকের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। আজ একজন, কাল অন্যজন, পরশু আরেকজনকে দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কারও পক্ষেই জাহাজটি মেরামত করা সম্ভব হচ্ছিল না। বিদেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আপ্রাণ চেষ্টা করেও কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না। এমন অবস্থায় মালিক এক বুড়ো কারিগরের কথা জানতে পারলেন। বুড়ো নাকি তার যুবক বয়সে এমন একটি সমস্যার সমাধান করেছিলেন। বুড়োকে ডেকে পাঠালেন জাহাজের মালিক।

যন্ত্রপাতির বিশাল এক বাক্স নিয়ে হাজির হলেন বুড়ো কারিগর। এসেই কাজে হাত দিলেন। ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালোভাবে পরখ করলেন।

জাহাজের মালিক কাজ দেখার জন্য বুড়োর সঙ্গে লেগে থাকলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন, বুড়ো কিভাবে জাহাজ মেরামত করেন।

জাহাজের যন্ত্রপাতি পরখ শেষ করলেন বুড়ো। এবার তার বিশাল বাক্স থেকে ছোট্ট একটি হাতুড়ি বের করলেন। তারপর ইঞ্জিনের একটি জায়গায় ধীরে ধীরে কয়েকটি বাড়ি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। কাজ শেষে বুড়ো তার হাতুড়ি বাক্সে রাখলেন।

খুব খুশি জাহাজের মালিক। হাসিমুখে জানতে চাইলেন, ‘এ কাজের জন্য আপনাকে কত টাকা পারিশ্রমিক দিতে হবে?’

বুড়ো কারিগর বললেন, ‘এক লাখ টাকা।’

জাহাজের মালিক অবাক হলেন। বললেন, ‘বলেন কি! তেমন কিছুই তো করেননি! সামান্য হাতুড়ি পিটিয়ে এত টাকা? দুইশ টাকার কাজও তো নয়।’

বুড়ো কারিগর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, হাতুড়ির বাড়ি মারার জন্য দুইশ টাকা। আর বাকি ৯৯ হাজার আটশ টাকা- কোথায় হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারতে হবে- সেটা জানার জন্য।’

বন্ধুরা, এ গল্পের নীতিকথা হলো- উদ্যম নেয়ার আগে কোথায় উদ্যমী হতে হবে সেটা জানা জরুরি। অভিজ্ঞতাকে খাটো করে দেখতে নেই।

(এক কাপ কফি)

বন্ধুরা, এবার আমরা যে গল্পটি শোনাব তার মূল বক্তব্য সুখ নিয়ে। গল্পটি কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে। এসময় একসঙ্গে লেখাপড়া করেছেন তারা। এখন যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত। কেউ চাকরি করেন; কেউ ব্যবসা। একদিন তারা সবাই মিলে দেখা করতে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে। তার বাড়িতে হাজির হলেন সবাই। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন তারা। একসময় তাদের আলাপ-আলোচনা অভিযোগের দিকে মোড় নিল। নিজেদের কাজের চাপ আর ব্যস্তজীবন নিয়ে নাকাল অবস্থার কথা বলাবলি করছিলেন তারা।

এসময় রান্নাঘরে গেলেন অধ্যাপক। ফিরে এলেন বড় একটি পটে কফি নিয়ে। ট্রেতে নিয়ে এলেন কয়েকটি কাপ। সেগুলোর কোনোটি চীনামাটির। কোনোটি কাচের। কোনোটি প্লাস্টিকের। কোনোটি ক্রিস্টালের। কোনোটি দেখতে একবারেই সাদামাটা। কোনোটি খুবই দামি। আবার কোনোটি অভিজাত।

ছাত্রদের নিজ হাতে কফি নিতে বললেন শিক্ষক। যে যার মতো ট্রে থেকে কাপ নিয়ে কফি ঢেলে নিলেন। এখন সব ছাত্রের হাতেই একটি করে কফির কাপ।

এবার অধ্যাপক বললেন, ‘তোমরা কি খেয়াল করেছ, দেখতে সুন্দর এবং দামি কাপগুলোই তোমরা নিয়েছ? বাকি সাদামাটা আর সস্তা কাপগুলো ট্রেতে পড়ে আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। আমরা সবাই নিজের জন্য ভালোটাই চাই। কিন্তু সেটাই আমাদের জীবনের সমস্যা আর কঠিন চাপের উৎস।’

ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে একটু থামলেন অধ্যাপক। তারপর আবার বললেন, ‘কোনো কাপই কফির গুণাগুণ বাড়াতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো শুধু দামি হয় এবং আমরা কী পান করছি তা ধারণ কিংবা আড়াল করে।’

ছাত্ররা অধ্যাপকের কথা মন দিয়ে শুনছিল। তিনি এবার বললেন, ‘শোনো, তোমাদের সবার প্রকৃত চাওয়া ছিল কফি। নিশ্চয় কাপ নয়! কিন্তু তোমরা সবাই সচেতনভাবেই দেখতে সুন্দর দামি কাপগুলোই নিয়েছ। তারপর একে অন্যের কাপগুলো দেখতে শুরু করেছ। কারটা কেমন কাপ।’

একটু থেমে শিক্ষক আবার বললেন, ‘এবার তুলনা করে দেখ, জীবনটা হল কফি আর চাকরি-ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, টাকা-পয়সা, অবস্থান সব কিছুই হল কাপ। আমাদের যে ধরনের কাপই থাকুক না কেন, আমরা জীবনের গুণাগুণ বদলাতে পারব না।’

বন্ধুরা, এ গল্পের শিক্ষা হলো-  চারপাশে সবকিছু ঠিক থাকা মানেই সুখী হওয়া নয়। অভাব-অভিযোগের মধ্যেই সুখ খুঁজে নিতে হয়।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে থাকছে বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের ছোট্টবন্ধু আফিয়া ইবনাত ইলার কণ্ঠে কবি সুকুমার রায়ের লেখা বিখ্যাত কবিতা 'জীবনের হিসাব'।

ইলার চমৎকার আবৃত্তিটি আমাদেরকে সত্যিই মুগ্ধ করেছে। আশা করি তোমাদেরও ভালো লেগেছে। তো বন্ধুরা, এবার শুনবে ছোট্টবন্ধুদের সববেত কণ্ঠে একটি গান। 'গুন গুন করে মৌ' এই শিরোনামের গানটির গীতিকার- এমএম মুশফিক, সুরকার- আরফিন সাঈদ আর শিল্পী আর শিল্পী: আফসা, আফরা ও নেহা।

বন্ধুরা, তোমরা 'হেভেন টিউন নাশিদ ব্যান্ড' পরিবেশিত গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৭