রংধনু আসর
ভোরে ঘুম থেকে ওঠার উপকারিতা
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, শরীরটাকে সুস্থ রাখতে হলে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, ব্যায়াম ও বিশ্রামের দরকার। সবচেয়ে ভালো বিশ্রাম হলো ঘুম। তাই বলে সবসময় ঘুমালে চলবে না। তাড়াতাড়ি ঘুমাবে আর খুব সকালে অর্থাৎ সূর্য উঠবার আগেই ঘুম থেকে উঠবে- কেমন?
সকালে মানে ভোরে ঘুম থেকে ওঠা সবদিক থেকেই ভালো। ভোরের টাটকা হাওয়ায় দেহ-মন ভালো থাকে। কথায় বলে- 'সকালের হাওয়া, সাত কবিরাজের দাওয়া'। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠেন, তাঁরা অনেক বেশি এনার্জিটিক হন। কোনও কাজ করতে খুব কম সময় নেন তারা। শুধু তাই নয়, কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, পরিকল্পনা করতে এবং লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাঁরাই সেরা হন।
বন্ধুরা, সকালে ঘুম থেকে ওঠার উপকারিতা সম্পর্কে তো জানলে। এবার আমরা দেরিতে ওঠার কুফল নিয়ে কথা দু/একটি কথা বলব। গবেষণায় দেখা গেছে- দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কারণে বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক জটিলতার শিকার হতে হয়। শুধু তাই নয়, যারা রাতে দেরি করে ঘুমাতে যান এবং সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন তাদের অকালে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই আমাদের প্রত্যকেরই উচিত- সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে তোলা।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারণ ভোররাতে বা দিনের শুরুর অংশে কল্যাণ ও বরকত সবচেয়ে বেশি থাকে। শুধু ইবাদত-বন্দেগিই নয়, পার্থিব কাজের জন্যও সময়টি খুবই উপযুক্ত, মনোরম ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। রাসুল (সা.) ভোরবেলার কাজের জন্য বরকতের দোয়া করেছেন।
বন্ধুরা, তোমরা কি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠো? ফজরের নামায পড়ো? নাকি অলসতায় গা এলিয়ে দিয়ে সময়টাকে পার করে দাও? না না এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। এমনটি করলে কিন্তু কেউ আর তোমাদেরকে আদর করে গালে চুমু এঁকে দেবে না।
কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কথা ও মশিউর রহমানের সুরে শিশু-শিল্পী সুরাইয়া আক্তার শাম্মা ও তার সঙ্গীদের কণ্ঠে গানটি শুনলে। আশা করি এখন থেকে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করবে।
তো বন্ধুরা, আজকের আসরে আমরা ভোর বেলায় ঘুম থেকে ওঠার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব। আর গল্পের পর থাকবে ঢাকার এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান আর উপস্থাপনায় রয়েছি আমি রংধনুর নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্প শোনা যাক।
বিজ্ঞানমন্ত্রী বোযর্গমেহের ও বাদশাহ খসরু
অনেক দিন আগের কথা। ইরানের বাদশাহ খসরু নওশিরওয়ানের বিজ্ঞানমন্ত্রী বোযর্গমেহের একদিন খুব সকালে খসরুর দরবারে গেলেন। খসরুর সঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। কিন্তু তখনও খসরু ঘুম থেকে না ওঠায় ঘণ্টাখানেক দেরি হলে গেল।
বোযর্গমেহেরের খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ছিল। বহুবার খসরুকে সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে ওঠার পরামর্শ দিয়ে বলতেন: 'দ্রুত ঘুম থেকে ওঠেন তাহলে সফলকাম হবেন'।
খসরু রাতের বেলা গান-বাজনা নিয়ে মত্ত থেকে দেরিতে ঘুমাতেন এবং সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন। বোযর্গমেহেরের এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া খসরুর কাছে অপমানজনক মনে হতো বলে তাঁর মন খারাপ হতো। কিন্তু তিনি বোযর্গমেহেরের কথা খুব সম্মানের সাথে শুনতেন। কারণ, তার ভালো কাজের প্রতি খসরুর অগাধ ভরসা ছিল।
ঐদিন সকালে উপদেশ দিয়ে বললেন: 'সকালের ঘুম একটা অপছন্দনীয় অভ্যাস আর দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা খসরুর জন্য বেমানান। দ্রুত থাকলে ঘুম থেকে ওঠা সকলের জন্য সর্বদা সফলতার অন্যতম উৎস'।
খসরু বোযর্গমেহেরের কথাগুলো শুনলেন কিন্তু উত্তর দিলেন না। তবে তিনি মনে মনে ভাবলেন: "এই কল্যাণকামীমন্ত্রী হাল ছাড়ার পাত্র নয়। প্রতিদিন একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। একদিন এমন এক অবস্থা করব যাতে সে নিজেই দ্রুত ঘুম থেকে ওঠার কুফলটা দেখতে পায়। তারপর আমরা রাজসভায় তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করব।"
ঐদিন পার হয়ে গেলে আরেকদিন নওশিরওয়ান দুইজন পেয়াদাকে আদেশ দিয়ে বললেন: "নিজেদের পোশাক পরিবর্তন করে ভবঘুরেদের মত সাজবে। আগামীকাল খুব সকালে যখন অন্ধকার থাকবে, বোযর্গমেহের যে পথ দিয়ে দরবারে আসে তোমরা ওখানে লুকিয়ে থাকবে। যখনই বুঝবে বোযর্গমেহের তোমাদের কাছাকাছি এসেছে তখন তাকে চোরদের মত ভয় দেখাবে এবং তার পোশাক নিয়ে চলে যাবে। যাতে সে বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার পোশাক পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু লক্ষ্য রাখবে তার যেন আঘাত না লাগে আর এই কথা যেন কেউ জানতে না পারে।"
পরদির খুব সকালে অন্ধকার থাকতে থাকতেই তারা মূল রাস্তায় চলে গেল। নিজেদের মাথা ও মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল। হঠাৎ করে বোযর্গমেহেরের ওপর আক্রমণ করে বলল: "তুমি যে-ই হও না কেন, প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে চাইলে তোমার কাছে যা আছে আমাদেরকে দিয়ে দাও।"
বোযর্গমেহের বললেন: "আমি বাদশাহর মন্ত্রী। রাজদরবারে যাচ্ছি। আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও। তা না হলে তোমরা বন্দী হবে।"
এ কথা শুনে তারা হাসতে হাসতে উপহাস করে বলল: তুমি এসব মিথ্যা কথা বলে আমাদের ভয় দেখাচ্ছ। কিন্তু আমরা রাতের চোর। মন্ত্রী বা উকিল কাউকে চিনি না। তাড়াতাড়ি করো, যা আছে দিয়ে দাও আর নিরাপদে চলে যাও নতুবা খারাপ কিছু হবে।"
বোযর্গমেহের বললেন:" আমার কাছে সোনা-রুপা নেই। আমি একজন ধার্মিক মানুষ আর জ্ঞান-প্রজ্ঞাই হচ্ছে আমার সম্পদ যা বাদশাহ ও দুর্বলদের কাজে আসে। যদি তোমরা চাও তবে তোমাদেরকে উপদেশ দিতে পারি।"
তারা উত্তর দিল: "যদি তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি থাকতো তাহলে মাঝ রাতে এই গলিতে থাকতে না আর নিজেকে বাদশাহর মন্ত্রী দাবি করতে না। উপদেশ যদি থাকে তা নিজেকে দাও। এখন তো তোমার টাকা-পয়সাও নেই, তাই তোমার গায়ের পোশাকগুলোই আমাদেরকে দিয়ে দাও। ওগুলোই আমাদের জন্য যথেষ্ট। হয় নিজেই খুশি মনে ওগুলো খুলে ফেলো- না হয় তোমার কাছ থেকে জোর করে নেব।
বোযর্গমেহের নিরুপায় হয়ে তার পোশাকগুলো তাদের দিয়ে দিলেন এবং শুধু হাফপ্যান্ট পড়ে বাসায় ফিরে গেলেন। তারপর অন্য একটি পোশাক পরে দরবারে আসলেন। সেদিন দরবারে আসতে দেরী হয়ে গেল বোযর্গমেহেরের। নওশিরওয়ান দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন: আজকে কেন দেরিতে এসেছ?
বোযর্গমেহের বললেন: "তাড়াতাড়িই এসেছিলাম। চারদিক অন্ধকার ছিল বলে গলিতে চোরদের কবলে পড়েছিলাম। তারা আমার পোশাক নিয়ে গিয়েছিল। নিরুপায় হয়ে বাড়ি গিয়ে অন্য পোশাক পড়ে এসেছি।"
খসরু অর্থবহুল একটি হাসি দিয়ে বললেন: ভালো, ভালোই হলো। অবশেষে তুমি অতি সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরিণতিটা নিজেই দেখতে পেলে। এ ঘটনার পর আবারও আমাদেরকে প্রতিদিন বলবে নাকি যে, 'দ্রুত সকালে ঘুম থেকে ওঠো তাহলে সফলকাম হবে'! তাহলে তোমার নিজের সফলতাটা কোথায়? না কি আজ পোশাক হারানোর সফলতার জন্যই দ্রুত ঘুম থেকে উঠেছ?
বোযর্গমেহের উত্তর দিলেন: "আমি চোরেদের কবলে পড়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি এ কথা যেমন সত্য- তেমনি আমি এখনও বিশ্বাস করি যে- দ্রুত ঘুম থেকে উঠলে সফলতা আসবেই। আপনারাই বিচার করুন আজকে যেহেতু চোরেরা আমার আগেই ঘুম থেকে উঠেছিল সে কারণে তারা সফলকাম হয়েছে। আমার কাপড়গুলো তাদের ভাগ্যে জুটেছে।"
বোযর্গমেহেরের এই উপস্থিত বুদ্ধির কারণে বাদশাহ নওশিরওয়ান অনেক আনন্দিত হলেন। তিনি বোযর্গমেহেরের পোশাকগুলো আনার নির্দেশ দিয়ে বললেন: "এই পরীক্ষামূলক ঘটনাটি আপনার জ্ঞান বুদ্ধি যাচাইয়ের জন্য ছিল। নিঃসন্দেহে সকালে ঘুম থেকে ওঠা বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন যা সফলতা ও সুস্বাস্থ্যের অন্যতম উৎস।"
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুকে। ওর নাম ইশরাকুল করিম চৌধুরী।

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে বিদায় নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।