সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২ ১৫:৫৯ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা যখন গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন তথ্য ও দাঁতভাঙ্গা সূত্রগুলো পড়ো তখন নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হয়, যারা এই নিরস তথ্য ও সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন তারা আসলে ব্যক্তি জীবনে কেমন ছিলেন? তারাও কি তাদের তত্ত্বের মতোই নিরস ও নির্জীব ছিলেন?

তোমরা সত্যি সত্যিই যদি এমনটি মনে করো তাহলে তোমাদের ধারণা ভুল। কারণ তাদের ব্যক্তিজীবন ছিল বেশ হাস্যরসাত্মক। তাদের জীবনেও অসাধারণ, মজার অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটেছে রংধনুর আজকের আসরে আমরা কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কিছু মজার কাহিনী তোমাদেরকে শোনাবো। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই অন্যতম বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছো। বিজ্ঞানীদের কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে তার কথা। আপেক্ষিকতা তত্ত্বসহ অনেক কঠিন কঠিন তত্ত্বের আবিষ্কারক আইনস্টাইনের জীবনে কিন্তু মজার ঘটনা একেবারে কম নেই।

আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আইনস্টাইন। তত্ত্বটি বোঝাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করতেন। একদিন একটি সেমিনারে বক্তব্য দিতে গেলেন আইনস্টাইন। তখন তার ড্রাইভার তাকে বলল, স্যার আপনাকে একটা অনুরোধ করব। আইনস্টাইন বললেন, হ্যাঁ, কর। ড্রাইভার বলল, স্যার, আপনি সব সেমিনারে তো একই কথা বলেন, আমার সব কথা মুখস্থ হয়ে গেছে। তো আজ যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তো আপনাকে কেউ চিনে না। তো এটাই সুযোগ, আমি হব আইনস্টাইন আর আপনি হবেন আমার ড্রাইভার। কেউ বুঝতে পারবে না।

আইনস্টাইন বলল, ভালো বলেছ তুমি। বেশ মজা হবে। ঠিক আছে যাও।

যেমন কথা তেমন কাজ। আইনস্টাইন বসলেন পিছনের সারিতে আর তার ড্রাইভার যথারীতি মঞ্চে সাবলীলভাবে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। দর্শকদের করতালির মাধ্যমে তার বক্তব্য শেষ হলো। বিপত্তি ঘটলো বক্তব্য শেষ হবার পরে। একজন বিজ্ঞানী এসে বলল, স্যার আপনার বক্তব্যের এই অংশ আমি বুঝতে পারি নাই, আমাকে একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

আইনস্টাইনের ড্রাইভার ছিল খুব চালাক। তিনি একটুও না ঘাবড়িয়ে বললেন, ও এটা! এটা তো খুবই সহজ, আমার ড্রাইভারও তো এটা পারে। যান ওনার কাছ থেকে বুঝে নিন।

বন্ধুরা, এবার শোনাব বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের টিকেট বিড়ম্বনার একটি গল্প। দিন কয়েকের জন্য প্রথমবারের মতো এক বড় শহরে বেড়াতে গিয়েছেন আইনস্টাইন। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাসে চেপে হোটেলে ফিরছেন।

বাসের কন্ডাক্টর টিকেট চাইলে তিনি খুবই বিব্রতবোধ করলেন। এ পকেট সে পকেট হাতড়ে কোথাও টিকেট পেলেন না। কন্ডাক্টর তাঁকে বিব্রত হতে দেখে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনাকে আর ব্যস্ত হতে হবে না।  টিকেটটা কোথাও পড়ে গেছে হয়তো।’

এ কথা শুনে আইনস্টাইন বিচলিত হয়ে বললেন, ‘আরে না, কী বলছ তুমি! টিকেট না পেলে আমি হোটেলে ফিরব কী করে? টিকেটের উল্টো পাশে হোটেলের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল যে!’ 

আইনস্টাইন একবার রেলগাড়ির ডাইনিংয়ে রাতের খাবার খেতে এসে দেখলেন, চশমা ফেলে এসেছেন। খালি চোখে মেন্যুও পড়া যাচ্ছে না। তিনি ওয়েট্রেসকে ডেকে বললেন, দয়া করে এটা পড়ে দাও। 

ওয়েট্রেস তাঁর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘দুঃখিত স্যার, আমার পড়াশোনার দৌড়ও আপনার মতোই।’ 

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছো যে, আইনস্টাইন ছিলেন একজন ভুলোমনা মানুষ। আইনস্টাইন একবার কোনো একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর নিজের বাড়ি গেলেন এবং দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে আইনস্টাইন-এর স্ত্রী জবাব দিলেন আইনস্টাইন বাসায় নাই। তখন আইনস্টাইন ভাবলেন বাড়ির কর্তা যেহেতু বাড়িতে নেই তাই এখানে অপেক্ষা করার কোন মানে নাই। এটা ভাবতে ভাবতে তিনি আবার চলে গেলেন। 

বন্ধুরা, এবার আমরা বৈদ্যুতিক বাতি ও গ্রামোফোনের আবিষ্কারক টমাস আলফা এডিসনের গল্প শোনাব। এডিসন পড়াশোনায় অতটা ভালো ছিলেন না। এমনটি স্কুল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক তার মা'কে বলেছিলেন–"আপনার ছেলেটা বিশিষ্ট গর্দভ। ওকে দিয়ে পড়াশোনার কিচ্ছু হবে না। মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নাই। এই স্কুলে ওকে আর রাখা যাবে না।"

পড়াশোনায় ভালো না হলেও ছোটবেলা থেকেই এডিসন ছিলেন কৌতুহলপ্রবণ। তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর। একদিন মা-বাবা অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখতে পেলেন এডিসন হাঁসের খাঁচার মধ্যে ঢুকে বসে আছে।

কী ব্যাপার- খাঁচার কেন?- জানতে চাইলে এডিসন বললেন, 'হাঁস কিভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায় তাই দেখছিলাম'।

অনেক দিন আগের ঘটনা। এক বুড়ি মহিলা তার জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির এক বুড়োকে দেখল, বুদবুদ বানাচ্ছে। একদিন- দুইদিন- তিনদিন এভাবে বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করার পর বুড়ির মনে হলো লোকটি হয়তো পাগল। বুড়ি পুলিশে ফোন করল। পুলিশ এসে খোঁজ নিয়ে দেখল ইনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন। তিনি তখন বুদবুদের গায়ে জে রংধনুর রঙ সৃষ্টি হয় তার কারণ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।

বিজ্ঞানী নিউটন একবার তার বন্ধুকে দাওয়াত দিলেন। কিন্তু নিজেই ভুলে গেলেন। তিনি নিজের খাবার ঢেকে রেখে বাইরে চলে গেলেন। এ সময় তার বন্ধু এসে তাকে ঘরে না পেয়ে তার খাবার দেখে ভাবলেন নিউটন খাবারটা হয়তো তার জন্য রেখে বাইরে চলে গেছেন। সে খেয়ে শুয়ে পড়ল।

শোবার আগে সে বাসনপত্র আগের মত ঢেকে রেখে দিল। নিউটন বাসায় এসে তার বন্ধুকে দেখে ভাবলেন তিনি বন্ধুর বাসায় চলে এসেছেন। কিন্তু না। ওইতো খাবার ঢাকা আছে। খাবার খেতে গিয়ে দেখলেন খাবার নাই। তিনি ভাবলেন বোধহয় তিনি খাবার খেয়ে বাইরে গিয়েছিলেন!

বন্ধুরা, ভুলোমনা বিজ্ঞানীদের তালিকা থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও কিন্তু বাদ যাননি! বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু একবার সায়েন্স কংগ্রেসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে গিয়েছিলেন। আর জাপান ভ্রমণের সময়ের তিনি তো লুঙ্গি পরেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন পুরো সফর!

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একদিন তার মেয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার বায়না ধরল। সত্যেন্দ্রনাথ তখন গণিতের একটা জটিল সমস্যা সমাধানে চিন্তামগ্ন। তারপরও মেয়ের জোরাজুরিতে রাজি হলেন।

মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন সিনেমা হলে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ বাসায় ফেলে এসেছেন। চিন্তিত মুখে মেয়েকে সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষা করতে বলে একই ঘোড়ার গাড়িতে বাসায় ফিরে এলেন।

টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা তুলতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি পড়ল কিছুক্ষণ আগে শেষ করতে না পারা বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির সমাধানের ওপর। তারপর ভুলে গেলেন সিনেমা দেখার কথা। মেয়েকে যে সিনেমা হলের সামনে একা ফেলে এসেছেন ভুলে গেলেন তাও। সবকিছু ভুলে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সমস্যাটির সমাধানে।

এদিকে গাড়োয়ান অপেক্ষা করছে। দু’ঘন্টা পরেও যখন বিজ্ঞানী বের হচ্ছেন না তখন গাড়োয়ান সাহস করে ঘরে ঢুকে দেখে বসু চেয়ারে বসে অংক কষছেন। গাড়োয়ান যখন ডাক দিল সত্যেন্দ্রনাথ চমকে উঠলেন, “কী হল?”

গাড়োয়ান সিনেমায় যাওয়া আর মেয়ে সিনেমা হলে একা অপেক্ষা করছে বলাতে সত্যেন্দ্রনাথ সম্বিত ফিরে পেলেন এবং তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে থাকেন। কবিকে দেখতে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু মাঝে মাঝেই কলকাতা থেকে পাড়ি দিতেন শিলাইদহে। থাকতেন অনেক দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক বোটে চেপে সপরিবারে বেরিয়ে পড়তেন পদ্মার কোনো চরে। নির্জন চরে কিছুদিন সন্তানদের নিয়ে বাস করতেন বেদে-বেদেনীদের মতো। সঙ্গে থাকতেন জগদীশ বসুও।

জগদীশ বসুর ভাব শুধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই ছিল না। তাঁর ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন তিনি। জগদীশ বসুর সঙ্গে তিনি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতেন।

জগদীশচন্দ্র বসু শিলাইদহে আসতেন শীতকালে। শীতে রোদ পোহাতে কার না ভালো লাগে? তবে ভয় লাগে গোসল করতে গেলে। আমাদের যেমন লাগে, বিজ্ঞানীদেরও লাগে। তার ওপর পদ্মার পানি এ সময় একেবারে বরফশীতল। কিন্তু গোসল তো করতে হবে। তাই একটা অদ্ভুত ফন্দি আঁটেন বিজ্ঞানী মশাই।

শীতকালে পদ্মার পানি কমে যায়। দুপাশে বালুচর। নরম বালুতে কবরের মতো গর্ত খুঁড়তেন জগদীশচন্দ্র বসু। অনেকগুলো গর্ত। সেই গর্তের একটাতে তিনি শুয়ে পড়তেন। আর অন্যগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েরা। মাথায় তিনি একটা ভেজা গামছা জড়িয়ে নিতেন। তারপর গর্তের ভেতর শুয়ে শরীরে রোদ লাগাতেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর শরীর গরম হয়ে উঠত। আর রোদ সহ্য করতে পারতেন না। তখন রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দৌড়ে ঝাঁপ দিতেন পদ্মার বুকে। উত্তপ্ত শরীরের পদ্মার শীতল জলের ছোঁয়ায় ভেসে যেতেন প্রশান্তির সাগরে।

বন্ধুরা, তোমরা হয়তো জানো যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘ফোবিয়া’ বলে কথা আছে। বাংলায় ‘আতঙ্ক’ বললে বোধ হয় আরও ভালো শোনায় কথাটা। আতঙ্কের ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের ভেতরেও কাজ করে। অথচ বিজ্ঞানীদের কাজই হলো মানুষের জীবনকে কীভাবে নিরাপদ ও আরও উন্নত করা যায় সে পথ খোঁজা।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করে তিনি সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। জলাতঙ্ক নির্মূল করার ওষুধ আবিষ্কার যিনি করেছেন, তিনিই কি না আতঙ্কে ভুগতেন! তা-ও আবার জীবাণুর আতঙ্ক।

জীবাণু নিয়েই তাঁর কাজ-কারবার। তাই ভালো করেই জানতেন কোথায় কোথায় সবচেয়ে বেশি জীবাণু থাকে। সেই জানাটাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনের চোখে দেখতেন চারদিকে ‘জীবাণুরা করে হাউ হাউ’। তাই সব সময় সতর্ক হয়ে চলতেন। কারও সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চাইতেন না। পাস্তুর জানতেন মানুষের হাত হলো জীবাণুর ডিপো।

একদিন এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন পাস্তুর। তিনি তখন বিখ্যাত। প্রায়ই সমাজের বড় বড় মানুষের পায়ের ধুলো পড়ে তাঁর বাড়িতে। সেদিনও একজন এসেছিলেন। সরকারের বড় কোনো কর্মকর্তা। পাস্তুর তাঁকে দেখে বেজায় খুশি। বেমালুম ভুলে বসেছেন জীবাণুর কথা। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন গণ্যমান্য লোকটার দিকে। হ্যান্ডশেক করার পরেই মনে পড়ল আতঙ্কের কথা! সবর্নাশ। এক দৌড়ে চলে গেলেন সাবান দিয়ে হাত ধুতে। গণ্যমান্য ব্যক্তিটা তো একেবারে থ!

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জ্ঞানে-গুণে, মেধা-মননে অনেক বড় হয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করতে চাও! তোমাদের মনের স্বপ্নগুলো নিয়ে একটি গান লিখেছেন আবদুল লতিফ। আর গানটি গেয়েছে বাংলাদেশের শিশু শিল্পী শাফিন বিন তারেক।  

গানটি শুনলে, আশা করি ভালো লেগেছে। তো বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ