অক্টোবর ১৫, ২০২২ ১৬:০২ Asia/Dhaka
  • ইরানি শিবিরগুলো পরিদর্শন করলে সেগুলোকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে যে কারো ভুল হতে পারত।
    ইরানি শিবিরগুলো পরিদর্শন করলে সেগুলোকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে যে কারো ভুল হতে পারত।

আজ আমরা যুদ্ধের ময়দানে ইরান শিবিরের আধ্যাত্মিক পরিবেশ নিয়ে কথা বলব।

ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের আট বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার জন্য ওই যুদ্ধে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর ভূমিকা উপলব্ধি করতে হবে।  আমরা গত আসরেও বলেছি, ইরানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমামের সম্পর্ক অন্য দশটি দেশের সেনাবাহিনীর মতো ছিল না বরং এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের রেখে যাওয়া শিক্ষা। সমসাময়িক যুগে ইসলামি ও ঐশী শাসনব্যবস্থার সুস্পষ্ট আদর্শ স্থাপন করেছিলেন ইমাম খোমেনী (রহ.)। ইসলামি জীবনবিধান সম্পর্কে ইমামের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এ কারণে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী দিক-নির্দেশনা দিতেন।

ফলে ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি কখনও ইসলামি শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাননি। ঠিক এ কারণে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানি সেনা কমান্ডার ও সাধারণ সৈনিকেরা অন্ধের মতো ইমামের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ইরানি যোদ্ধারা ইমাম খোমেনীর নির্দেশকে শুধু সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নয় সেইসঙ্গে একজন আধ্যাত্মিক নেতা ও পীরে কামেল হিসেবেও বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ছোটখাট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেনা কমান্ডাররা ইমামের মৌলিক দিক-নির্দেশনাকে আদর্শ হিসেবে ধরে নিয়ে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতেন।

একজন রাজনীতিবিদ ও ইরানের মতো একটি বিশাল দেশের নেতা হওয়ারও আগে ইমাম খোমেনী ছিলেন একজন আরেফ বা সুফিসাধক এবং তার সকল কর্মকাণ্ড আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পরিচালিত হতো। তিনি ইরানি সমাজে ঈমানদারি ও তাকওয়ার বীজ বপন করেছিলেন এবং কোটি কোটি মানুষ তাকওয়া অর্জনের দীক্ষা নিতে ইমামের চারপাশে জড়ো হয়েছিলেন। ইমামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহা অপরাধী সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসন থেকে দেশ ও বিপ্লবকে রক্ষা করতে লাখ লাখ যুবক ইরানের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে ছুটে গেছেন। দেশরক্ষার পাশাপাশি এসব যুবকের সামনে আরেকটি মহান লক্ষ্য ছিল; আর তা হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এসব যুবকের অন্তর ঈমান ও তাকওয়ায় পরিপূর্ণ ছিল বলে তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুকে ভয় পেত না।

ইরাকের আগ্রাসী সেনাদের নির্দয় আচরণের সামনে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারার পেছনে যে নিয়ামক শক্তিটি কাজ করেছে তা ছিল আধ্যাত্মিক শক্তি এবং আহলে বাইতের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ইমাম খোমেনী (রহ.) তার এক ভাষণে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের বিজয়ে আধ্যাত্মিক শক্তিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “যারা রাতের বেলা আরামের ঘুম হারাম করে নামাজ, দোয়া ও মুনাজাতে মগ্ন হয় যুদ্ধে বিজয় তো তাদেরই জন্য।”

ইমাম যে কারণে এই বক্তব্য দিয়েছে তা হলো, ইরানি যোদ্ধাদের বেশিরভাগ গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। তারা জিকির-আসগার, কুরআন তেলাওয়াত এবং আল্লাহর কাছে মুনাজাত ও কান্নাকাটি করে রাত পার করে দিতেন।

রাতের বেলা ইরানি শিবিরগুলো পরিদর্শন করলে সেগুলোকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে যে কারো ভুল হতে পারত। ইরানি যোদ্ধারা অর্থ বুঝে কুরআনের আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতেন। তারা যুদ্ধের ময়দানে কুরআনের এই শিক্ষা বাস্তবায়ন করতেন এবং তার ফলও হাতেনাতে পেয়ে যেতেন। যেমন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসেনাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকার জন্য সূরা ইয়াসিনের ৯ নম্বর আয়াতটি তেলাওয়াত করতেন যেখানে আল্লাহ বলছেন: “আর আমি তাদের সামনে প্রাচীর ও পেছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি। তারপর তাদেরকে আবৃত করেছি; ফলে তারা দেখতে পায় না।” আবার ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর প্রতি গুলিবর্ষণের সময় সূরা আনফালের ১৭ নম্বর আয়াতের একাংশ পড়ে নিতেন যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রাসূলকে উদ্দেশ করে বদর যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন: “আর আপনি যখন নিক্ষেপ করেছিলেন তখন আপনি নিক্ষেপ করেননি বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন।”

ইরানি শিবিরগুলো পরিদর্শন করলে সেগুলোকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে যে কারো ভুল হতে পারত। ইরানি যোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়সংকল্প থাকা এবং আল্লাহর সাহায্য লাভ করার জন্য সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করতেন যেখানে বলা হয়েছে: “হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।” সেইসঙ্গে তারা আরো তেলাওয়াত করতেন সূরা বাকারার ২৫০ নম্বর আয়াত যার একাংশে বলা হয়েছে: “হে আমাদের রব! আমাদের উপর ধৈর্য ঢেলে দিন, আমাদের পা অবিচলিত রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে জয়যুক্ত করুন।” এছাড়া, যুদ্ধের ময়দানে প্রতিদিন সূরা ইয়াসিন পাঠ করা ইরানি যোদ্ধাদের একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।

শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি ইরানি যোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, গীবত ও গুপ্তচরবৃত্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও কুরআনের সাহায্য নিতেন। তারা সূরা হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করতেন যেখানে আল্লাহ বলছেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।” পবিত্র কুরআনের এসব মহামূল্যবান আয়াতের পাশাপাশি ইরানি যোদ্ধারা হাদিস থেকে গৃহিত বিভিন্ন দোয়া পাঠ করে শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। এভাবে যুদ্ধের ময়দানে ইরানি শিবিরগুলো হয়ে উঠেছিল আধ্যাত্মিকতা চর্চার এক অনবদ্য ময়দান।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/১২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ