নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৫:১৯ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৬): ইরানি সাহসি যোদ্ধা ও কমান্ডার আব্বাস বাবায়ি

প্রকৃতপক্ষে ইরাক-ইরান যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারণে যে বিষয়টি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে তা ছিল ইরানি যোদ্ধাদের গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস। পরকালকে সামনে রেখে পার্থিব জীবনকে সাজিয়ে নেয়ার নামই ধর্মীয় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী একজন মানুষ পৃথিবীর কোনো ঘটনাকেই পরকালের সঙ্গে সম্পর্কহীন মনে করেন না বরং তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে তিনি যা কিছু করেন তার প্রতিটি কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে।

এমনকি প্রতিটি মুহূর্ত তিনি কীভাব কাটিয়েছেন তার জন্যও পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাবদিহী করতে হবে। একজন ঈমানদার মানুষ একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, পবিত্র কুরআন হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ এবং মানুষের সৌভাগ্য অর্জনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছু এই মহাগ্রন্থে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন।

ঈমানদার মানুষ আরো জানেন যে, মহানবীর আহলে বাইত বা পবিত্র বংশধরগণ ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং তারা ছিলেন খোদাপ্রেমিকদের পথপ্রদর্শক। ঈমানদার মানুষ বিশ্বাস করেন, মৃত্যু মানে বিলীন হয়ে যাওয়া নয় বরং মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ এক জগত থেকে আরেক জগতে স্থানান্তর হয় মাত্র। পরকালে মানুষ হয় জান্নাতবাসী ও সৌভাগ্যবান হবে অথবা হবে জাহান্নামি ও দুর্ভাগা। কাজেই এই বিশ্বাস বুকে ধারন করা একজন মানুষের সঙ্গে যে ব্যক্তি পার্থিব জগতকেই সবকিছুর শুরু ও শেষ মনে করে তার পার্থক্য থাকবেই।

ইরানি জনগণের মধ্যে যেমন ধর্মীয় বিশ্বাস গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে তেমনি পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধা ও কমান্ডাররাও ছিলেন ঈমানদারদের আদর্শস্থানীয়। আমরা এ আসরে ইরানের কয়েকজন কমান্ডারের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করব। ইরানি সাহসি যোদ্ধা ও কমান্ডার আব্বাস বাবায়ি ছিলেন এফ-১৪ যুদ্ধবিমানের পাইলট।  শহীদ হওয়ার সময় তিনি ইরানের বিমান বাহিনীর ডেপুটি চিফ ছিলেন।  বিমান চালনায় অসম্ভব দক্ষতার পাশাপাশি ঈমানি বলে বলীয়ান হওয়ার কারণে তার নাম পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

আব্বাস বাবায়ির সহকর্মীরা বলেন, আজানের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ আদায় করা ছিল শহীদ বাবায়ির জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তিনি ইসলামি বিপ্লবের আগে আমেরিকায় বিমান চালনা প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন। শহীদ বাবায়ি সে সময়কার একটি ঘটনার কথা নিজেই বলে গিয়েছেন। ইরানের এই মহান সেনা অধিনায়ক নিজের জীবদ্দশায় স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমেরিকার একটি সামরিক ক্যাডেট কলেজে আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক আমাকে সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছিল না। আমাকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয় কিনা তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। একদিন আমাদের কোর্স কো-অর্নিডারের দপ্তরে আমার ডাক পড়ে। তিনি ছিলেন একজন জাদরেল মার্কিন জেনারেল। আমাকে ডেকে তিনি এমন কিছু প্রশ্ন করলেন যা শুনে বুঝলাম আমার প্রতি তিনি যেকোনো কারণেই হোক বিরাগভাজন হয়ে রয়েছেন।

শহীদ বাবায়ি আরো বলেন, দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ওই সাক্ষাৎকারে আমার মনে হয়েছিল, আমার এতদিনের পরিশ্রম হয়তো বৃথা যেতে বসেছে এবং আমাকে হয়তো সার্টিফিকেট ছাড়া খালি হাতেই ইরানে ফিরে আসতে হবে। আমি যখন এরকম সাত-পাঁচ ভাবছিলাম তখন এক ব্যক্তি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করে এবং জেনারলকে একটি জরুরি কাজে ডেকে নিয়ে যায়। আমি তখন কিছুক্ষণের জন্য জেনারেলের রুমে একা হয়ে পড়ি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি জোহরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। আমি মনে মনে বলি, এখন যদি এখানে না থাকতাম তাহলে নামাজটি পড়ে নিতে পারতাম। জেনারেলের ফিরে আসতে দেরি হচ্ছিল। এমন সময় আমার মনে হলো- নামাজ পড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো কাজ থাকতে পারে না। আমি এখানে এই মুহূর্তে নামাজ আদায় করব। আমি রুমের এক কোণে গিয়ে নিজের হাতে থাকা পত্রিকা বিছিয়ে নামাজ পড়তে শুরু করে দিলাম।

শহীদ বাবায়ি আরো বলেন, নামাজের মধ্যেই টের পেলাম জেনারেল রুমে প্রবেশ করেছেন। মনে মনে বললাম- নামাজ শেষ করব নাকি নামাজ ভেঙে ফেলব? মনে মনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, নামাজ শেষ করি এরপর আল্লাহ যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। নামাজ শেষ করে জেনারেল সামনের চেয়ারে বসতে বসতে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। জেনারেল কিছুক্ষণ নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন- কি করছিলেন? বললাম- আমি প্রেয়ার আদায় করছিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন- আরেকটু বুঝিয়ে বলুন।  আমি বললাম- আমাদের ধর্মে ইবাদতের জন্য দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় আছে যখন আমাদেরকে ইবাদত করতে হয়। আপনার অনুপস্থিতিতে সেই ইবাদতের সময় হয়ে যাওয়ায় আমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইবাদতটি করে নিয়েছি। আমার ব্যাখ্যা শুনে জেনারেল মাথা ঝাঁকালেন। বললেন- আপনার ফাইলে যেসব কথা লেখা আছে তার সব বোধ হয় এই ইবাদতকেন্দ্রীক অভিযোগ।

বুঝতে পারলাম, সময়মতো আমার নামাজ আদায় করা নিয়ে আমার ফাইলে কিছু অভিযোগ লেখা ছিল যা তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু এখন আমার ব্যাখ্যা শুনে আমার ধর্মীয় বিশ্বাস ও ইবাদতে একনিষ্ঠ দেখে তিনি খুশি হয়েছেন। জেনারেলকে দেখলাম পকেট থেকে কলম বের করে আমার ফাইলে সাইন করলেন। এরপর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, কংগ্রাচুলেশন্স। আপনি পাস করেছেন। আপনার সার্বিক কল্যাণ কামনা করছি। আমিও তাকে সম্মান জানিয়ে স্যালুট দিয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এরপর নিজের রুমে এসে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানাতে সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম এবং দু’রাকাত শোকরানা নফল নামাজ আদায় করলাম।

শহীদ বাবায়ির হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল এবং তিনি অসহায়কে সাহায্য করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতেন না। শহীদ আব্বাস বাবায়ি বিভিন্ন যুদ্ধবিমানে তিন হাজার ঘণ্টা উড্ডয়ন করেছেন। ১৯৮৭ সালে অর্থাৎ ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক বছর আগে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইরাকের বিরুদ্ধে ৬০টি সফল বিমান অভিযান পরিচালনা করেছেন। #

পার্সটুডে/এমএমআই/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ