ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৭): ইরানি কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ বোরুজেরদি
ইরানি জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। ইরানের তরুণ ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস অত্যন্ত গভীর ছিল বলেই তারা স্বৈরাচারী শাহ সরকার উৎখাতের আন্দোলনে একজন আলেমকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মতো একজন আধ্যাত্মিক নেতার নেতৃত্বে ইরানি জনগণ এদেশের মাটি থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উৎখাত করেছিল।
ইরানের অনেক রাজনৈতিক দল বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থি কমিউনিস্টরা বহু বছর ধরে মার্কিনপন্থি শাহ সরকারকে উৎখাতের আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। কিন্তু এদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হওয়ায় কমিউনিস্টরা জনগণের মধ্যে মোটেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অন্যান্য সেক্যুলার রাজনৈতিক দলের ডাকেও ইরানের জনগণ তেমন একটা সাড়া দেয়নি।
কিন্তু ইমাম খোমেনী ডাক দেয়ামাত্র জনগণ স্বৈরাচারী শাহ সরকারের উৎখাতকে নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতে থাকে। বিপ্লবের আগে প্রায় দুই দশক ইমাম নির্বাসনে ছিলেন। তিনি বিদেশ থেকে তাঁর সহযোগীদের মাধ্যমে ইরানে বার্তা পাঠাতেন এবং তিনি যখনই বলতেন অমুক দিন সবাই রাজপথে নেমে আসুন সেদিন রাজপথে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। ইমাম খোমেনীর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য জনগণ নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল। এই একই ঘটনা প্রযোজ্য হয়েছে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও। ইমামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যখন আপামর জনসাধারণ যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছে তখন আর এই জাতিকে ঠেকিয়ে রাখার শক্তি ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দামের হয়নি।

ইরানি জনগণ বিশেষ করে এদেশের সেনাবাহিনী ও সেনা কমান্ডারদের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গত সপ্তাহে ইরানের তৎকালীন বিমান বাহিনীর উপপ্রধান শহীদ মেজর জেনারেল আব্বাস বাবায়ির জীবনী নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা এরকম আরেকজন শহীদ কমান্ডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। আজ যাকে নিয়ে কথা বলব তিনি হচ্ছেন মোহাম্মাদ বোরুজেরদি, তবে জনগণের কাছে তিনি মাসিহ কুর্দিস্তান নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। শহীদ বাবায়ি যেমন ভালো রেজাল্ট নিয়ে কলেজ পাস করে বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন মোহাম্মাদ বোরুজেরদির জীবনটা সেরকম ছিল না। মাত্র ছয় বছর বয়সে বোরুজেরদির পিতা মারা যান বলে তিনি লেখাপড়া বেশিদূর চালাতে পারেননি। অভাবের সংসারে সেই শিশু বয়স থেকেই রোজগারের চিন্তা করতে হয়েছে তাকে।
তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে মোহাম্মাদ বোরুজেরদি ছিলেন আপোষহীন। এ সম্পর্কে তার ভাই বলেন, “সে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ত তখনই সে রোজা রেখে স্কুলে যেত। জোহরের আজান হলে ওজু করে স্কুলের এক প্রান্তে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিত। সে যদিও আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট ছিল কিন্তু তারপরও সব সময় আমাকে বলত: ভাইয়া! তোমারও উচিত রোজা রাখা এবং সময়মতো নামাজটা পড়ে নেওয়া। ” মোহাম্মাদ বোরুজেরদি তরুণ বয়সেই শাহ বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েছিলেন। কিছুদিন শাহ সরকারের কারাগারে বন্দি থাকেন তিনি। এরপর সরকার বিরোধী গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি সিরিয়া ও লেবানন সফর করেন এবং সেখানে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে থেকে গেরিলা যুদ্ধ রপ্ত করেন। ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর ইমাম খোমেনী নির্বাসিত জীবন শেষ করে দেশে ফিরে আসলে মোহাম্মাদ বোরুজেরদি ইমামের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নির্দেশে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বোরুজেরদি। বিদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী কমান্ডার হিসেবে তাকে আইআরজিসি’র প্রধান কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।

ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের কুর্দিস্তান অঞ্চলে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইমাম খোমেনী ওই বিদ্রোহ দমনে যে সেনাদল পাঠান তাতে বোরুজেরদি কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেন। সেখানে তার নেতৃত্বে ইরাক সীমান্তের কাছে পিরানশাহর ও সারদাশত শহরের বিপ্লববিরোধী বিদ্রোহীদের দমন করা হয়। বোরুজেরদি কুর্দিস্তানের জনগণকে ভালোবাসতেন বলেই সেখানকার সাধারণ জনগোষ্ঠীকে মুষ্টিমেয় বিপ্লব বিরোধী বিদ্রোহীর হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালান। তিনি বলতেন, কুর্দিস্তানে বিদ্রোহী দমনের অভিযান কখনোই বন্ধ করা উচিত হবে না।
মোহাম্মাদ বোরুজেরদি কীভাবে ‘মাসিহ কুর্দিস্তান’ খেতাব পেলেন সে সম্পর্কে ইরানের তৎকালীন ইসলামি দিকনির্দেশনা মন্ত্রী আলী জান্নাতি বলেন, যখন ইরানের সবাই ধরে নিয়েছিল যে, কুর্দিস্তান এদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাবে তখন এই অঞ্চলকে ইরানের সঙ্গে একীভূত রাখতে নিরলস প্রচেষ্টা চালান মোহাম্মাদ বোরুজেরদি। তার জীবন উৎসর্গকারী ভূমিকাই তাকে মাসিহ কুর্দিস্তান খেতাব এনে দেয়। মাসিহ হচ্ছে হযরত ঈসা (আ.) এর অপর নাম। মোহাম্মাদ বোরুজেরদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং আম্বিয়াগণের মতো অত্যন্ত দয়াদ্র আচরণ করে মানুষের ভেতরটা পাল্টে দিতে পারতেন বলে তাকে মাসিহ কুর্দিস্তান নামে অভিহিত করা হয়। কুর্দিস্তানের বিদ্রোহীরা ওই অঞ্চলে দ্বিতীয় ইসরাইল গঠন করার যে ধৃষ্টতাপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছিল বোরুজেরদির নেতৃত্বে তা অঙ্কুরেই শেষ করে দেয়া হয়।
বোরুজেরদির কথা স্মরণ করতে গিয়ে ইরানের স্বনামধন্য কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাত বলেন, “অনেক সময় আমাদের কমান্ডাররা পরিশ্রম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন এবং নতুন করে কাজে নামার উদ্যোম হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তারা যখন বোরুজেরদির সঙ্গে কথা বলতেন তখনই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতেন এবং নতুন করে কাজে নামার অনুপ্রেরণা পেতেন। তিনি কোনো ভুল করলে অকপটে তা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিতেন। ”
মোহাম্মাদ বোরুজেরদি ১৯৮৩ সালের ২২ মে ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলার সময় কুর্দিস্তানে এক অভিযান চালাতে গিয়ে ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন। শাহাদাতের সময় তিনি একটি গাড়িতে ছিলেন এবং তার সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা অন্য কমান্ডাররাও শাহাদাতবরণ করেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।