নভেম্বর ০১, ২০২২ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৩৮): শহীদ কমান্ডার হোসেইন আলামুল হুদা

১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়া পর ইরানি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি শক্তিশালী হয় এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার প্রসার ঘটে। তবে যুদ্ধের ময়দানে ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধের যে অভাবনীয় বিকাশ দেখা গিয়েছিল সেটা শুধুমাত্র বিপ্লব পরবর্তী ওই পরিবেশের কারণে হয়নি।

ইরানি জনগণের মধ্যে এই মূল্যবোধ আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে শহীদ ইরানি যোদ্ধাদের জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত জীবনের দিকে তাকালে এই সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজ আমরা যাকে নিয়ে কথা বলব তিনি হলেন সাইয়্যেদ হোসেইন আলামুল হুদা। এই বীরযোদ্ধা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হুয়াইজা শহরে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে অকুতোভয় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।  

সাইয়্যেদ হোসেইন আলামুল হুদা ১৯৫৮ সালে ইরানের প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুর্তজা আলামুল হুদার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন অধ্যয়ন শুরু করেন। তার জীবনের অন্যতম নেশা ছিল কিতাব অধ্যয়ন। স্কুল জীবন থেকেই তিনি ইসলামি আন্দোলন শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে একজন ভালো বক্তায় পরিণত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি মাশহাদ শহরের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ইতিহাস বিষয়ক ক্লাসের পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন কোর্সেও স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। এরমধ্যে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)-র নেতৃত্ব ইসলামি বিপ্লব শুরু হলে তিনি ওই আন্দোলনে যোগ দেন।

জনগণকে স্বৈরাচারী শাহ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি সারা ইরান চষে বেড়ান। বিশেষ করে তিনি মাশহাদ, কেরমান ও আহওয়াজ শহরে তার রাজনৈতিক তৎপরতাকে কেন্দ্রীভূত করেন।  মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে অত্যাচারী শাহ সরকার প্রথমবারের মতো কারাবন্দি করে। এরপর শহীদ আলামুল হুদার বয়স যখন ২১ বছর তখন ইসলামি বিপ্লব সফলতা লাভ করে। এই সাত বছরে তিনি বহুবার কারাবন্দি হন এবং কারাগারে তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর পতিত শাহ সরকারের দোসররা নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ শুরু করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং শহীদ আলামুল হুদা বিদ্রোহ দমনের কাজে অংশ নেন। 

ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনীর নির্দেশে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। শহীদ আলামুল হুদা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান শহরে আইআরজিসি প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন শুরু করলে শহীদ আলামুল হুদা সদ্য প্রতিষ্ঠিত আইআরজিসির যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে খুজিস্তান এলাকায় আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফ্রন্টে যুদ্ধ তদারকির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন শহর থেকে সৈন্য দলে লোক ভর্তি করে তাদেরকে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে প্রেরণ করার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

বিপ্লব পরবর্তী ভঙ্গুর অবস্থায় দেশের কোনো বাহিনীর পক্ষেই যখন ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না তখন শহীদ আলামুল হুদার মতো কিছু জানবাজ যোদ্ধার নেতৃত্বে ইরানের আপামর জনসাধারণ স্বল্পতম অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলেন। ইরাকি বাহিনী ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহর শহর দখল করে নেয়ার পর শহীদ আলামুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইরানি যোদ্ধাদের একটি দল ইরাকের একটি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ইরাকি বাহিনীকে শহর থেকে বিতাড়িত করা ছিল ওই আক্রমণের উদ্দেশ্য। কিন্তু আলামুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাহিনী হুয়াইজা শহরের উপকণ্ঠে শত্রুসেনাদের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

এ সময় সামান্য কিছু সমরাস্ত্র নিয়ে ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর অন্তত ২০টি ট্যাংকের মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু এই অসম যুদ্ধে আলামুল হুদার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা একে একে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে থাকেন।  আলামুল হুদার অসহায়ত্ব যেন এখানেই শেষ হওয়ার ছিল না। আগ্রাসী ইরাকি সেনারা আলামুল হুদার মরদেহের উপর দিয়ে ট্যাংক চালিয়ে দেয় এবং হুয়াইজা শহরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।  শহরটির একটি দেয়ালও সেদিন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শহীদ আলামুল হুদার সঙ্গে সেদিনের অকুতোভয় সম্মুখ সমরে ১৪০ জন ইরানি যোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। 

শহীদ আলামুল হুদা যুদ্ধকে ঐশী পরীক্ষা এবং শাহাদাতকে ঐশী সৌভাগ্য লাভের উপায় বলে মনে করতেন। তিনি খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযান শুরু করার আগে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে দেয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেন: আজ রাত আমাদের জন্য আশুরার রাতের সমতুল্য। আমরা আজ একটি ঐশী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি। আমাদেরকে আজ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আগ্রাসী বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ইরাকি বাহিনীর আগ্রাসনের মোকাবিলায় যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে নেমেছে আপনারা তাদের সম্মুখ সারিতে রয়েছেন।

শহীদ আলামুল হুদা সহযোদ্ধাদের আরো বলেন, আপনারা অভিযানে যাওয়ার সময় যখন হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ দেখেছেন তখন উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, আপনাদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ইরানি ভূখণ্ড দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হবে এবং এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে পারবে। আপনারা যদি আজই ময়দানে না নেমে একদিনের জন্যও দেরি করে ফেলেন তাহলে শাহাদাতের সৌভাগ্য আপনাদের কপালে নাও জুটতে পারে। আপনারা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন আপনারা খোররামশাহর থেকে জীবিত ফিরে আসতে পারবেন না। আবারও বলছি, আপনারা এই মুহূর্তে একটি মহা ঐশী পরীক্ষার সম্মুখীন। 

আলামুল হুদা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের শাহাদাতের ১৮ মাস পর ১৯৮১ সালের ৮ মে খোররামশাহরের সঙ্গে হুয়াইজা শহরও শত্রুমুক্ত করেন ইরানি যোদ্ধারা।  তারা ওই ১৪০ শহীদের প্রায় সবার দেহাবশেষ খুঁজে পান এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শাহাদাতের স্থানেই তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।