নভেম্বর ১২, ২০২২ ১৬:০৬ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি তোমরা ভালোভাবেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছো। আসরের শুরুতেই তোমাদের একটা প্রশ্ন করি। আচ্ছা, তোমরা পড়াশোনা করছো কিসের জন্য?

কী ব্যাপার! এই প্রশ্ন শুনে একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ী করছো কেন? ও বুঝতে পেরেছি, তোমরা আসলে দ্বিধায় পড়ে গেছো- কী উত্তর দেবে তা ভেবে। আসলে প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তরটি একেবারে সহজ নয়। কারণ, কেউ পড়াশোনা করে চাকরি করার জন্য, কেউবা করে জ্ঞানার্জনের জন্য। তবে ঠিকমত জ্ঞানার্জন করে নিজেকে যোগ্য করে তৈরি করতে পারলে ভালো চাকরি-বাকরিও পাওয়া সম্ভব।

বন্ধুরা, জ্ঞানার্জনের কথা উঠলেই সবার আগে চলে আসে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা। তারপর আসে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) এর কথা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে সবচে বড় জ্ঞানী হলেন আলী ইবনে আবি তালিব।

হাদিসে এসেছে, একদিন নবীজী উচ্চস্বরে বললেন, 'আমি হলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানের শহর আর আলী হলেন সেই শহরের দরোজা। তাই যে-ই জ্ঞান অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেন এই শহরের দরোজার কাছে যায়।'

সত্যি বলতে কী- হযরত আলী (আ.) এর জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার তুলনা মেলা ভার। তিনি ছিলেন আরবি ব্যাকরণের জনক। তাঁর মেধা, তাঁর জ্ঞানের কথা প্রবাদতুল্য। হযরত আলী ছিলেন রাজস্ব প্রথার উদ্ভাবক। তিনিই সর্বপ্রথম ভূমিরাজস্ব প্রথা প্রবর্তন করে ভূমির ওপর চাষীদের অধিকার নিশ্চিত করেন।

বন্ধুরা, হযরত আলী (আ.) কেমন জ্ঞানী ছিলেন- তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে এই ঘটনাটি থেকে। একদিন হযরত আলী (আ.) মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন: “হে লোক সকল! আমাকে হারানোর পূর্বেই, আমার কাছে জিজ্ঞাসা কর। আমার নিকট থেকে জেনে নাও, কেননা পূর্ববর্তী ও উত্তরবর্তীদের জ্ঞান আমার নিকট বিদ্যমান। আল্লাহর শপথ, যদি বিচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়, ইহুদীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে, ইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য সে কিতাব থেকে, যবূরের অনুসারীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে, আর কুরআনের অনুসারীদের জন্য কুরআন থেকে তবে সেভাবেই বিচার করব... আল্লাহর শপথ, আমি কুরআন ও তার ব্যাখ্যায় সকলের চেয়ে জ্ঞানী।

এরপর তিনি বললেন: আমাকে হারানোর পূর্বেই আমাকে জিজ্ঞাসা কর। কুরআনের যেকোনো আয়াত সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করো, আমি তার জবাব দিব; বলতে পারব তার অবতীর্ণ হওয়ার সময় সম্পর্কে, কার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে, নাসেখ ও মানসূখ সম্পর্কে, আর বলতে পারব সাধারণ ও বিশেষ আয়াত সম্পর্কে, মোহকাম ও মোতাশাবিহ আয়াত সম্পর্কে, মাক্কী ও মাদানী আয়াতসমূহ সম্পর্কে...।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, ইমাম আলী (আ.) কেমন জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছিলেন। রংধনুর আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব। এরপর থাকবে তেহরান প্রবাসী এক বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। আর উপস্থাপনায় রয়েছি আমি গাজী আবদুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

একবার অনেক লোক হযরত আলীকে (আ.) ঘিরে মসজিদে বসেছিল। একজন ভদ্রলোক মসজিদে প্রবেশ করল এবং সুযোগ বুঝে বলল: হে আলী! আমার একটি প্রশ্ন আছে। আর তা হচ্ছে এই যে, জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?

উত্তরে হযরত আলী বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা জ্ঞান হচ্ছে নবীদের মি'রাসী সম্পদ আর ধন হচ্ছে কারুন, ফেরাউন, হামান ও শাদ্দাদের মি'রাসী সম্পদ।"

লোকটি নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে চুপ হয়ে গেল। এমন সময় আরেক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল এবং যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল প্রশ্ন করল: "হে আবুল হাসান! আমার একটি প্রশ্ন আছে জিজ্ঞেস করার অনুমতি আছে কি?

ইমাম আলী উত্তরে বললেন: অনুমতি আছে, জিজ্ঞেস করতে পারো! লোকটি যেহেতু সবার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল জিজ্ঞেস করল: জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?"

আলী (আ.) বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা জ্ঞান তোমাকে রক্ষা করবে, কিন্তু ধন-সম্পদকে তুমি রক্ষা করতে বাধ্য।"

লোকটি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই বসে পড়ল।

এবার তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করল, সেও পুনর্বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। আর ইমাম (আ.) তার উত্তরে বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা জ্ঞানী ব্যক্তির অনেক বন্ধু রয়েছে, কিন্তু ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তির শত্রু হচ্ছে বেশি।"

তখনও ইমামের (আ.) কথা শেষ হয়নি- চতুর্থ ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল। সে তার বন্ধুদের পাশে বসে হাতের লাঠি সামনে রাখল এবং জিজ্ঞেস করল: "হে আলী! জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?"

হযরত আলী (আ.) সেই লোকটির উত্তরে বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা যদি সম্পদ হতে তুমি ব্যয় কর তা কমতে থাকবে; কিন্তু যদি জ্ঞান হতে কাউকে শিক্ষা দান কর তা বৃদ্ধি পাবে।"

এবার ছিল পঞ্চম ব্যক্তির পালা। কিছুক্ষণ পূর্বে সে মসজিদে প্রবেশ করে মসজিদের কোনে এক স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ইমামের কথা শেষ হতেই পুনর্বার সে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল।

হযরত আলী (আ.) সেই লোকটির উত্তরে বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা জনগণ ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তিকে কৃপণ মনে করে, কিন্তু আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে মহত্ত্ব ও সম্মানের সাথে মনে করে।"

ষষ্ঠ ব্যক্তি প্রবেশ করার সাথেই সবাই পেছনে ফিরে তাকাল, আশ্চর্যের সাথে সবাই তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জনসমষ্টির মধ্য হতে একজন বলে উঠল: অবশ্যই এ লোকটিও জানতে চায় যে, জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম! যারা তার কথা শুনছিল, ব্যঙ্গাত্মকভাবে হাসলো। লোকটি, সবার পেছনে বসে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল: হে আলী! জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?

ইমাম (আ.) জনগণের দিকে একবার ফিরে তাকালেন, অতঃপর বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা ধন-সম্পদকে চোর চুরি করে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু জ্ঞান চুরি হওয়া সম্পর্কে কোনো ভয় ভীতি নেই।"

লোকটি চুপ হয়ে গেল। জনগণের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল; আজ কি হল ! সবাই কেন একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে? আশ্চর্যভাবে সবার দৃষ্টি একবার হযরত আলীর  দিকে এবং আরেকবার নতুন প্রবেশকারী লোকদের উপর উপবিষ্ট হয়ে রইল। এমন সময় সপ্তম ব্যক্তি যে হযরত আলীর (আ.) কথা শেষ হবার কিছুক্ষণ পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করেছিল এবং জনগণের মাঝখানে বসেছিল সে জিজ্ঞেস করল: "হে আবুল হাসান! জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?"

ইমাম আলী সবাইকে নীরব থাকার ইশারা করে বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সম্পদও পুরোনো হয়ে যায় কিন্তু জ্ঞান যতই তার সময় যাক না কেন নষ্ট হয় না।"

লোকটি আস্তে আস্তে উঠল এবং তার বন্ধুদের পাশে গিয়ে বসল; তারপর বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল: নবীর (সা.) কথা অনর্থক ছিল না যে, 'আমি জ্ঞানের শহর ও আলী (আ.) তার তোরণ! তার কাছে যা জিজ্ঞেস করেছি, প্রত্যেকটির জবাব তার কাছে ছিল। জনগণের সামনে আমরা হাসির পাত্র না হয়ে যাই তাই অন্যদেরকে আসতে বারণ করে দেয়াটা ভালো হবে!

যে লোকটি তার পাশে বসেছিল সে বলল: কে বলতে পারে হয়তো যে কয়েকজন বাকি আছে তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থও হতে পারে। তখন জনগণের সামনে অপমানিত হবে আর আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে পৌঁছে যাবো!

এক ব্যক্তি যে দূরে বসেছিল- সে বলল: যদি সঠিক উত্তর দিয়ে দেয় তখন কি হবে? তখন আমাদেরকে জনগণের সামনে অপমানিত হতে হবে! লোকটি শান্তভাবে বলল: তোমাদের কি হয়েছে? এখনই পিছপা হয়ে যাচ্ছ! আমাদের কথা কি ছিল, তা কি ভুলে গেছ? আমাদেরকে অবশ্যই নবী করিম (সা.) যা বলেছেন তার বিপরীত কথা প্রমাণ করতে হবে।

এমন সময় অষ্টম ব্যক্তি প্রবেশ করে পূর্বের প্রশ্নটিই জিজ্ঞেস করল:
ইমাম তার উত্তরে বললেন: "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা ধন-সম্পদ শুধুমাত্র মৃত্যু পর্যন্ত তার মালিকের সাথে থাকে, কিন্তু জ্ঞান, এ পৃথিবীতে এবং মৃত্যুর পরও মানুষের সাথে থাকে।"

সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল, কেউই কোন কথা বলছিল না। সবাই ইমামের উত্তর শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল যে, নবম ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এবং জনগণের বিস্ময় ও আশ্চর্যের মধ্যেই জিজ্ঞেস করল: হে আলী ! জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?

ইমাম (আ.) মুচকি হেসে বললেন: জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা ধন-সম্পদ মানুষকে নিষ্ঠুর করে দেয়, কিন্তু জ্ঞান মানুষের মনকে আলোকিত করে দেয়।

জনগণের বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখ দরজার পানে চেয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল সবাই দশম ব্যক্তির অপেক্ষা করছিল। এমন সময় এক ব্যক্তি বাচ্চার হাত ধরে মসজিদে প্রবেশ করে। সে সবার শেষে বসে এক মুঠো খেজুর শিশুটির হাতে দিল এবং সামনের দিকে তাকালো। জনগণ যারা চিন্তা করছিল যে হয়তো আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না, সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল, এমন সময় লোকটি জিজ্ঞেস করল:
"হে আবুল হাসান! জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি উত্তম?

আলী বললেন : "জ্ঞান হচ্ছে উত্তম; কেননা ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা অহংকারী হয়, এমন কি কখনও প্রভু হওয়ার দাবিও করে বসে, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা সব সময় বিনয়ী হয়।"

জনগণের হৈ চৈ, হট্টগোল, খুশি ও প্রশংসাতে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। প্রশ্নকারীরা আস্তে আস্তে চুপচাপ জনগণের মাঝখান থেকে উঠে চলে গেল। যখন তারা মসজিদ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল ইমামের আওয়াজ শুনতে পেল যে, তিনি বলছিলেন: "যদি পৃথিবীর সকল লোক এই একটি প্রশ্নই আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে থাকে, তাদের প্রত্যেককে আমি বিভিন্ন রকম উত্তর দিতাম।"

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো তেহরানপ্রবাসী এক বাংলাদেশি ক্ষুদে বন্ধুকে।

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি আজকের আসর।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১২

 

 

ট্যাগ