নভেম্বর ১৫, ২০২২ ১৭:৪২ Asia/Dhaka
  • শাহ চেরাগ মাজারে সন্ত্রাসী হামলা
    শাহ চেরাগ মাজারে সন্ত্রাসী হামলা

গত ২৭ অক্টোবর বুধবার ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শিরাজ শহরে অবস্থিত হযরত আহমাদ বিন মুসা (আ.) মাজারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সংগঠনের এক সদস্যের নির্বিচার গুলি বর্ষণে ১৩ জিয়ারতকারী শহীদ এবং অপর প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনী হামলাকারীকে আহত অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হলেও কয়েক দিন পর সেও নিহত হয়। এরই মধ্যে দায়েশ বা আইএস জঙ্গি সংগঠন ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আইএস জঙ্গিরা কিভাবে ইরানের শত্রুদেরকে সহায়তা করছে সে সম্পর্কে আলোচনা করবে। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।

হযরত আহমাদ বিন মুসা (আ.)এর মাজার 'শাহ চেরাগ' নামে পরিচিত। নির্মম ও লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ইরানের জনগণ প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে। জিয়ারতকারীদের মধ্যে একটি পাঁচ বছরের শিশু প্রাণে বেঁচে গেলেও তার বাবা, মা ও ভাইসহ পরিবারের সবাই প্রাণ হারিয়েছে। হযরত আহমাদ বিন মুসা (আ.) হচ্ছেন বিশ্বনবী (সা.)এর আহলে বাইতের অন্যতম নক্ষত্র ইমাম রেজা (আ.)এর ভাই। অনেক বড় মাপের এই আউলিয়ার মাজার জিয়ারতের জন্য সারা বছর ধরে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন এবং এই ইমামযাদার ওসিলায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।

কিন্তু ওয়াহাবি ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী দায়েশ বা আইএস জঙ্গিরা মাজার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নয়। এ কারণে মাজারগুলো তাদের প্রধান টার্গেট। তাদের দৃষ্টিতে হয় মাজার থেকে দূরে থাকতে হবে অথবা মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকতে হবে। আইএস জঙ্গিরা এতোটাই উগ্র যে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়াসহ পশ্চিম এশিয়ার বহু ইমামযাদা ও ওলি আওলিয়ার মাজারে হামলা চালিয়ে সেগুলোর ক্ষতি করেছে অথবা সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে এবং বহু লোককে হত্যা করেছে।

অনেক মুসলিম দেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে যারা কিনা উগ্র ওয়াহাবি মতবাদ  দ্বারা প্রভাবিত। উদাহরণ স্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যে তৎপর আল কায়দা, নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম, ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে দায়েশ, পাকিস্তানে সেপাহে সাহাবা প্রভৃতি জঙ্গি গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যায় যারা কিনা তাদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় সহিংসপন্থা অবলম্বনে বিশ্বাসী। খ্রিস্টিয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে উগ্র ওয়াহাবি মতবাদের প্রচার শুরু হয়। ওয়াহাবি মতবাদ বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই মতবাদের  অনুসারীরা কারবালা, মক্কা ও মদিনায় বহু মাজার এবং ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ধ্বংস করেছে। এরপর ১৯৩২ সালে সৌদি আরবে আলে সৌদ পরিবার ক্ষমতায় আসার পর তাদের অর্থ সহায়তায় উগ্র ওয়াহাবিরা অন্যান্য মুসলিম দেশে আরো জোরেসোরে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার শুরু করে। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসা চালু করে। এসব ক্ষেত্রে তারা উগ্র মানসিকতার বহু ছাত্র গড়ে তুলেছে যারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সারা বিশ্বের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

উগ্র দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী যদিও ধর্মের লেবাসে আবির্ভূত হয়েছে কিন্তু তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে তারা আমেরিকা এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে এবং তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে। আমেরিকা মুখে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে ওয়াশিংটন আইএস জঙ্গিকে তাদের লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন দায়েশ বা আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক সদস্য এডওয়ার্ড স্লোডেন এ কথা ফাঁস করে দিয়েছেন যে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে আইএস জঙ্গি সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই জঙ্গিগোষ্ঠী সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করতো।

দায়েশ সন্ত্রাসীরা ইরাক ও সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীসহ বহু নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় পরাজিত হওয়ার পর বর্তমানে এরা সবচেয়ে বেশি তৎপর রয়েছে আফগানিস্তানে। আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ওই দেশটি জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আমেরিকা জঙ্গিদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য ইরাক ও সিরিয়া থেকে পলাতক দায়েশ সদস্যদেরকে আফগানিস্তানে এনে জড়ো করেছে। তালেবান ফের ক্ষমতা দখল করার পর আইএস জঙ্গিরা বিভিন্ন জনসমাগম এলাকা, মসজিদ  ও স্কুলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে বহু নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। সর্বশেষ রাজধানী কাবুলের একটি স্কুলে জঙ্গিদের হামলায় ৫৩ জন স্কুল ছাত্রী নিহত এবং আহত হয়েছে আরো শতাধিক ছাত্রী।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইরানের সাথে আমেরিকার দীর্ঘদিনের শত্রুতা বজায় রয়েছে। আমেরিকার সহযোগী হিসেবে দায়েশ বা আইএস জঙ্গিরাও ইরান বিরোধী তৎপরতায়  লিপ্ত। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর আমেরিকা শুধু যে এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েছে তাই নয় একই সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইরান এ অঞ্চলের জাতিগুলোর কাছে আদর্শে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে আইএস জঙ্গিরা দুটি কারণে ইরানের সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত। প্রথমত, তারা ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে মাজারগুলোতে জিয়ারতের তীব্র বিরোধী। আদর্শিক কারণে তারা প্রচণ্ড শিয়া বিদ্বেষী এবং এ কারণে তারা শিয়াদের হত্যা করা জায়েজ মনে করে। ইরানের সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের শত্রুতার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানির নেতৃত্বে ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গি বিরোধী সফল অভিযান। এর ফলে ইরাক ও সিরিয়া থেকে জঙ্গিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাদের স্বঘোষিত খেলাফতি  শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে। ইরাক ও সিরিয়ায় সৌদি-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট জঙ্গিরা পরাজিত হওয়ার দুই বছর পর মার্কিন সেনারা জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে শহীদ করে।

সর্বশেষ দায়েশ বা আইএস জঙ্গিরা ইরানের শিরাজ শহরের মাজারে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। এই হত্যাকাণ্ডের কোনো সামরিক গুরুত্ব  না থাকলেও আমেরিকা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক সন্ত্রাসীরা খুবই খুশী। ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকার একই সময়ে জঙ্গিদের এই বর্বরতার উদ্দেশ্য ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীই ইরানের বিরুদ্ধে নাশকতা চালাক না কেন তারা উপযুক্ত জবাব পেয়েছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ