রংধনু আসর
ইসলামের দিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম গণদাওয়াত
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নব্যুয়ত লাভের প্রথম তিন বছর খোলাখুলি ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাননি। ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কিংবা মক্কানগরী বেষ্টন করা পাহাড়ে তিনি মানুষের সাথে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলতেন।
যেখানেই তিনি যথাযোগ্য বুদ্ধিমান ও সচেতন কাউকে পেতেন, তাকে নিজের নবুওয়াতের ব্যাপারে কথা বলতেন এবং মূর্তিপূজা ও নিপীড়নের নিন্দা করতেন। তিনি সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বলতেন এবং দুর্বলদের অসহনীয় কষ্টকর অবস্থার প্রতি সহানুভূতি দেখানোর আহ্বান জানাতেন।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিরলস প্রচেষ্টায় বেশ কিছুসংখ্যক লোক এ তিন বছরে ইসলাম গ্রহণ করে এবং গোপনে তারা মুসলমান হয়ে যান। তখন নবীজী (সা.) আল্লাহর আদেশ পেলেন- নিকটাত্মীয়দেরকে উপদেশ দিন এবং সতর্ক করুন ৷
এই আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা) তাঁর নিকটাত্মীদের মধ্য থেকে ৪৫ জনকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের সামনে নিজস্ব রহস্য উন্মোচিত করবেন। আজকের আসরে আমরা সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটিই তোমাদেরকে শোনাব। সেইসাথে থাকবে একটি নাতে রাসূল। আর সবশেষে থাকবে ভারতের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান।
মহানবী সা) তার নিকটাত্মীয়দেরকে নিজ বাড়িতে একদিন রাতের খাবারের জন্য দাওয়ার করলেন। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছিল আর মেহমানদের আসার সময়ও ঘনিয়ে এসেছিল। কিশোর হযরত আলী (আ) মেহমানদের অভ্যর্থনার স্থানের দিকে একটু তাকালেন। সবকিছুই প্রস্তুত ছিল ৷
বনী হাশেম গোত্রের মুরুব্বীরা যাঁদের মাঝে রাসূলের অধিকাংশ চাচারাও ছিলেন, একেক করে সবাই প্রবেশ করছিলেন। আবু তালেব, হামযা, আব্বাস, আবু লাহাব এবং এমনকি রাসূলের সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ চাচা হারেসও এই আমন্ত্রণে উপস্থিত হলেন। রুমের ভেতর বিশাল দস্তরখান পাতা হলো। দস্তরখানের দুইপাশে ফিরোজা রঙের মাটির তৈজস বা পাত্র এনে রাখা হলো। আলী এবং যায়েদ সুস্বাদু অথচ খুবই সাধারণ খাবার দাবার মেহমানদের পরিবেশন করলেন।
খাবার খাওয়া শেষ হলে মুহাম্মাদ (সা.) কথা বলা শুরু করলেন। কিন্তু একজন তাঁকে বাধা দিল। এ লোকটি আবু লাহাব, নবীজীর চাচা। সে বললো 'সাবধান! মুহাম্মাদকে তোমাদের ওপর যাদু দিও না। আর এ কথা বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়ালো, অন্যরাও তাকে অনুসরণ করল।
বাড়ির বাইরে এসে অতিথিরা একে অন্যকে বলতে লাগলো, 'দেখেছো কীভাবে সে আমাদের সবাইকে খাইয়েছে? এটা বিস্ময়কর। সেখানে অল্প কিছু খাবার ছিল, অথচ আমরা সবাই পেটভরে খেয়েছি। আর কী সুস্বাদু খাবার!'
তাদের একজন জিজ্ঞেস করল এটা কীভাবে সম্ভব যে, অল্প কিছু খাবারে আমাদের সবার পেট ভরে গেল!'
তাদের একজন আবু লাহাবের ওপর রাগ করল। বলল : 'তুমি সমাবেশটা ভেঙে দিলে কেন? মুহাম্মাদ যা বলছিল তা আমাদের শোনা উচিত ছিল। কেন তুমি উঠে দাঁড়ালে, আর এত শিগগির চলে আসলে?'
এরপর মুহাম্মাদ (সা.) আবারও তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আলী (আ.)-কে বললেন: 'সেদিন আমি তাদের ইসলাম সম্পর্কে বলতে পারিনি। আবারও খাবার তৈরি কর এবং তাদের দাওয়াত করি। হতে পারে এবার তাদের সাথে কথা বলতে পারব। মহাসত্যের দিকে তাদের আহ্বান করতে পারব।'
দাওয়াতের দিনটি এলো। অতিথিরা আসলো। ঠিক আগের মতোই মুহাম্মাদ (সা.) তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং সসম্মানে তাদেরকে খাবার খাওয়ালেন। খাওয়া শেষ হলে মুহাম্মাদ (সা.) চাইলেন সব অতিথি যেন বসে থাকে আর তিনি যা বলেন, তা শোনে। তাদের কেউ চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু আবু লাহাবের মতো কেউ কেউ হৈ চৈ বাধানোর চেষ্টা করল।
নবী (সা.) তাদের বললেন: 'শুনুন, আমার কথা শুনুন, আল্লাহর দোহাই, এটা আপনাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য। আমি আল্লাহর সর্বশেষ নবী আর আমি আপনাদের জন্য, সমস্ত মানব জাতির জন্য ঐশী বিধান নিয়ে এসেছি যা হচ্ছে মুক্তি ও উন্নতির বার্তা। হে আমার আত্মীয়বর্গ। পরকালে ভালো কাজের জন্য আপনারা পুরস্কার পাবেন, আর খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাবেন। সত্যপন্থী লোকেরা বেহেশতের সৌন্দর্য পাবে, আর বিপথগামীরা জাহান্নামের যন্ত্রণা ভোগ করবে। হে আমার আত্মীয়-স্বজন! আমি আপনাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের সমস্ত কল্যাণ নিয়ে এসেছি। আর কেউ এর চেয়ে কল্যাণকর কিছু আনেনি। এ কাজে আপনাদের কে আমাকে সাহায্য করতে চান? কে আমার ভাই, পরামর্শক ও উত্তরাধিকারী হতে চান?”
এ পর্যায়ে সকল অতিথি নীরব। এ ঐশী আহ্বানে কেউ সাড়া দিল। না। শুধু আলী (আ.) যাঁর বয়স মাত্র ১৪ বছর। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : 'হে আল্লাহর নবী! আমি আপনাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।'
মুহাম্মাদ (সা.) নিজ চাচাতো ভাই কিশোর আলীর দিকে সস্নেহে তাকালেন। তারপর আবারও একই আহ্বান জানালেন- একই অনুরোধ জানালেন। ঠিক আগের মতোই সবাই নীরব। আর নীরবতা ভেঙে আলী (আ.) দৃঢ়স্বরে বললেন : 'হে আল্লাহর নবী! আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
নবী (সা.) নীরব থেকে আত্মত্যাগী যুবকের উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের প্রতি অর্থপূর্ণ একটি চাহনি বুলিয়ে নিলেন। তারপর আবারও বললেন : 'হে আমার আত্মীয়বর্গ! আমি আপনাদের জন্য উভয় জগতের কল্যাণ নিয়ে এসেছি। আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি আপনাদের আল্লাহর ইবাদত করার দিকে আহ্বান জানাই, তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানাই। এ কাজে কে আমাকে সাহায্য করবেন? কে আমার ভাই হবেন? আমার পরামর্শক ও আমার নির্দেশ বাস্তবায়নকারী, আমার উত্তরাধিকারী হবেন?'
আবারও সবাই নীরব। কেবল আলী (আ.) উঠে দাঁড়ালেন; এবার আরও দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, 'হে আল্লাহর নবী! আমি আপনাকে সাহায্য করতে তৈরি। আমি আপনাকে আপনার সকল ইচ্ছে পূরণে সহায়তা করবো।'
তারপর সকল অতিথিকে অবাক করে দিয়ে নবী (সা.) আলী (আ.) এর হাত ধরলেন এবং তার সহায়তা করার এ ওয়াদা গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি অতিথিদের দিকে ফিরলেন ও বললেন : এ যুবক আমার ভাই, পরামর্শক, নির্বাহী এবং আমার উত্তরাধিকারী। এর কথা শোনো এবং এর কথা মেনে চলো।'
এসময় মজলিশে এক ধরনের গুঞ্জন দেখা দিল। আবু লাহাব আবারো ঠাট্টা-মশকরা শুরু করল। এমন সময় রাসূলের সহযোগী ও সার্বক্ষণিক পৃষ্ঠপোষক চাচা আবু তালেব উঠে সমাবেশকে শান্ত হবার আহ্বান জানালেন এবং রাসূলকে সম্বোধন করে বললেন: হে প্রিয় বৎস! তুমি তোমার প্রতিপালকের বার্তা পৌঁছিয়েছো এবং আমরাও শুনেছি। এখন আমাদেরকে একটু চিন্তা-ভাবনা করার সময় দাও!'
আবু লাহাব আবারো শোরগোল করে পরিবেশটাকে অশান্ত করে তুললো। আবু তালিব এবার সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে বললেন : হে বংশের কলঙ্ক! ক্বাবার খোদার শপথ! আমরা তাকে সহযোগিতা করার জন্যে প্রস্তুত রয়েছি এবং শেষ পর্যন্তও তার সহযোগিতায় থাকব।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছো যে, সে সময়কার মূর্তি পূজা ও শিরকি ব্যবস্থার মধ্যে তৌহিদের পথে মানুষকে আহ্বান জানানো খুবই কঠিন কাজ ছিল। বিষয়টি ওই দাওয়াতের অনুষ্ঠান থেকেও স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি সব ধরনের বাধা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ মোকাবেলা করে তাঁর গণদাওয়াতী কাজ শুরু করেন।
এরপর নবীজী সাফা পর্বতের পাশে সমবেত জনগণকে একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের দিকে আহ্বান জানান। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ব্যাপক দক্ষতার সাথে তিনি মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান। এমনিতেই তিনি সততা ও আমানতদারীর জন্য প্রশংসিত ছিলেন। দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে তাঁর সেই সততা, অবস্থান ও অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেল। রাসূল নিজেই বলেছেন: "তোমাদের মাঝে আমার অবস্থান হলো সেই পর্যবেক্ষণকারী বা পাহারাদারের মতো, যে দূর থেকে শত্রুকে দেখতে পেয়ে নিজের কওমকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। হে কুরাইশ গোত্র , নিজেদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।"
রাসূলের এই বক্তব্য শুনে রাসূলের চাচা আবু লাহাব জনগণের মাঝে তীব্র হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল এবং রাসূলে খোদার বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটালো, আর লোকজনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিল। গণদাওয়াত দিতে গিয়ে নবী করীম ( সা ) নতুন এবং স্পর্শকাতর একটি পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলেন।
এরপর থেকেই কুরাইশ কাফেররা প্রকাশ্যভাবে বিরোধিতা শুরু করে দেয়। তারা ইসলামের অগ্রগতি রোধ করতে বিচিত্র ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় অতি দ্রুতই মুহাম্মাদের ধর্ম আরবের সীমানা ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি রাতে রাসূল। 'মারহাবা ইয়া মারহাবা' শিরোনামের নাতটি লিখেছেন তাফাজ্জল হোসাইন খাঁন। আর গেয়েছে বাংলাদেশের দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিশুশিল্পীরা।
ছোট্টবন্ধুদের চমৎকার কণ্ঠে হৃদয় শীতল করা নাতে রাসুলটি শুনলে। এবার রয়েছে বিশ্বনবী ও তাঁর আহলে বাইতপ্রেমী এক ছোট্টবন্ধুর সাক্ষাৎকার।
শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে বিদায়ই নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২