জানুয়ারি ০১, ২০২৩ ২৩:১৩ Asia/Dhaka
  • প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা
    প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা

পাশ্চাত্য সমাজ মানবাধিকার বিষয়টিকে তাদের অনেক বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরে। অথচ এদেশগুলোই আন্তর্জাতিক সম্পর্কে হস্তক্ষেপের অজুহাত হিসেবে মানবাধিকার বিষয়টির অপব্যবহার করছে। বলা যায় বর্তমান শতাব্দিতে মানবাধিকার ইস্যুটি পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় দ্বিমুখী আচরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে সংকটের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে সেখানে অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মানবাধিকার শ্লোগানের আড়ালে পাশ্চাত্য তাদের গোপন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। উদাহরণ হিসেবে ২০১৫ সালে ফ্রান্সে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার কথা উল্লেখ করা যায়। উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএস ওই হামলার  সাথে জড়িত ছিল। ওই হামলা এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে কয়েক দিন ধরে ফ্রান্স জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। সে সময় সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে  ফ্রান্সে সন্ত্রাসী  হামলার ঘটনা ছিল প্রধান খবর। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় আইএস জঙ্গিরা শুধু ইরাক কিংবা সিরিয়াতে নয় একইসাথে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রেও আঘাত  হানতে সক্ষম এবং সেখানেও তারা প্রভাব বিস্তার করেছে। প্যারিসে হামলার পরপরই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। এমনকি বিশ্বের প্রতিটি দেশ এবং জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকেও ফ্রান্স সরকারকে সমবেদনা জানানো  হয়।

প্যারিসে ভয়াবহ ওই সন্ত্রাসী হামলার পর বাগদাদ ও কাবুলসহ বিশ্বের আরো বহু দেশে একই ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল এবং এত শত শত মানুষ হতাহত হয়েছিল।  বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ার  দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলা হলে বিশ্বজুড়ে যেরকম প্রতিক্রিয়া হয় সেই তুলনায় এসব দেশে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বা নিন্দা জ্ঞাপন কিংবা সমবেদনা জানানোর বিষয়টি লক্ষ করা যায়নি। এ থেকে বোঝা যায় পাশ্চাত্যের বাইরে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামলা কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আফগানিস্তানের একটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা

আফগানিস্তান ও ইরাকে রক্তাক্ত যুদ্ধ ও অব্যাহত সন্ত্রাসী হামলা এবং ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে ইসরাইল ও সৌদি আরব যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তার পেছনে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সমর্থন রয়েছে। তারা কথায় কথায় মানবাধিকারের বুলি আওড়ায় অথচ তারাই দেশে দেশে জুলুম ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। পাশ্চাত্যের এ আচরণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।

গত বছর মে মাসে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে মার্কিন আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ৪১ হাজার আফগান নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে ৭১ হাজার ৩৪৪ জন ছিল বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিমান হামলায় ২০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরো হাজার হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে ৮০০ শিশুও রয়েছে।

'সংঘর্ষে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা' বিষয়ক একটি মার্কিন সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের হামলায় ১৬ হাজারের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে। আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৯ লাখ ডলার।

অন্যদিকে, ন্যাটো সামরিক জোটও বেপরোয়াভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। 'সশস্ত্র সহিংসতাকে ঘিরে যে কর্মপন্থা' নামক একটি সংস্থা কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে সাধারণ মানুষ হত্যায় ব্রিটিশ সেনাদের আচরণের কিছু নমুনা তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, "ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, '২০০৬ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে অন্তত ২৮৯ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ক্ষতিপূরণ বাবদ তারা ছয় লাখ ৮৮ হাজার পাউন্ড দিয়েছে'।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেয়া এ অর্থ খুবই সামান্য। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনেনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী পাশ্চাত্যের এ অপরাধযজ্ঞের কথা উল্লখ করে বলেছেন, 'বিশ্বের কোনো দেশই আমেরিকার মতো এতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি। মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে আমেরিকার যেমন কোনো দায় বদ্ধতা নেই তেমনি জাতিগুলোর মূল্যবোধ রক্ষায়ও তারা বিশ্বাসী নয়। তারা যে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে তা মানবাধিকারের প্রতি অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়।'  

মানবাধিকার বিষয়টি আসলে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন দিতে বা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই অবস্থা মানবাধিকারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রত্যাশার ওপর সরাসরি আঘাত। মানবাধিকারের দাবিদার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইরানের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র হামলায় ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামকে সমর্থন যুগিয়েছিল। পাশ্চাত্যের দেয়া ওই রাসায়নিক হামলায় ইরানের এক লাখের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো ইরানের সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ওই সন্ত্রাসীদের হামলায় এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ইরানি নিহত হয়েছে। ইরান বিরোধী এসব সন্ত্রাসীদের পাশ্চাত্যের মাটিতে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া, মানবাধিকারের দাবিদার এই দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইরানের সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এইসব বিষয় পাশ্চাত্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় দৃষ্টান্ত।

ইহুদিবাদী ইসরাইল দীর্ঘ বহু বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যা ও জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সৌদি আরবও পাশ্চাত্যের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে ইয়েমেনে বছরের পর বছর ধরে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসরাইল ও সৌদি আরবের বিষয়ে আমেরিকা ও ইউরোপ সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে।

জেনেভায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় নিযুক্ত ইরানের প্রতিনিধি ইসমাইল বাকিয়ে হামানে সম্প্রতি মানবাধিকার পরিষদে এক বক্তৃতায় এ অঞ্চলে বাইরের হস্তক্ষেপ এবং অমানবিক নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এটা খুবই লজ্জাজনক যে আমেরিকা মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে অথচ তারাই দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।   #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/     

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ