জানুয়ারি ১৩, ২০২৩ ২১:১৫ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী কুতুবুদ্দিন মাহমুদ বিন মাসুদ বিন মোসলেহ কাজরোনির অবদান নিয়ে আলোচনা করেছি যিনি কুতুবুদ্দীন শিরাজি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আজকের অনুষ্ঠানেও আমরা কুতুবুদ্দিন শিরাজির জীবনের আরো কিছু দিক ও তার গবেষণাকর্ম নিয়ে আলোচনা করবো।

কুতুবুদ্দিন শিরাজি ইরানের গৌরবোজ্জ্বল মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ পণ্ডিত। চিন্তগবেষণার শুরুতে তিনি সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পরবর্তীতে নিজের ঝোঁকটা নিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের দিকে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, সঙ্গীতশাস্ত্র আর চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি তিনি সুফিবাদ আর দর্শন চর্চায়ও পিছিয়ে ছিলেন না।

কুতুবুদ্দিন শিরাজির বাবা জিয়াউদ্দিন পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন। জিয়াউদ্দিন ধর্মীয় দিক দিয়ে একজন প্রভাবশালী সুফি ছিলেন। তিনি মধ্যযুগের আরেক বিখ্যাত সুফি সাহাব আল দীন ওমর সোহরাওয়ার্দীর কাছে একটি খেরকা বা সুফি আলখেল্লা উপহার পেয়েছিলেন, যা ছিল অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার। শিরাজির বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয়, তখন তার বাবা তাকে এই আলখেল্লাটি আশীর্বাদস্বরূপ পরিয়ে দেন। অবশ্য, প্রাপ্তবয়স্ক শিরাজি নিজগুণেই সেকালের আরেকজন বিখ্যাত সুফি নজিব আল দীনের কাছে একটি খেরকা উপহার পেয়েছিলেন। মুসলিম সমাজে তখন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী শৈশবেই কুরআন এবং হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন শিরাজি।

শিরাজির বাবা মুজাফ্‌ফারি হাসপাতালে একজন অপথ্যালমোলজিস্ট ছিলেন। এবং বাবার মৃত্যুর পর সেখানে তিনি চিকিৎসাবদ্যিায় পড়াশোনার পাশাপাশি কিছুদনি চিকিৎসকের কাজও করেন। ১৮ বছর বয়সে তার ডাক্তারি পড়ালেখার ইতি ঘটে। ২৪ বছর বয়সে তিনি ডাক্তারি পেশা চিরতরে ত্যাগ করেন।

ডাক্তারি ছেড়ে হঠাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন কুতুবুদ্দিন সিরাজি। তিনি সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত নাসির উদ্দিন আল তুসির শিষ্যত্ব লাভ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার জন্য। ১২৬০ সালে আল তুসি, মঙ্গোল শাসক হালাকু খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় মারাগেহ শহরে 'মারাঘা' অবজারভেটরি বা  পর্যবেক্ষণকারী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। অবজারভেটরি সম্পর্কে শিরাজি এতটাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে তিনি আল তুসির অধীনে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিত শিক্ষা শুরু করেন। এ সময়, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি ইবনে সিনার 'ইশারাত' গ্রন্থটির উপর দক্ষতা অর্জন করেন সিরাজি।

মারাগাহ শহরে সম্ভবত ৩ বা ৪ বছর কাটান তিনি। এরপর শুরু হয় তার জ্ঞানানুসন্ধানের ভ্রমণ। ১২৬৬ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি খোরাসান, জোভিয়ান, ইস্ফাহান এবং বাগদাদ ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি নাজম আল দীন কাতেবি এবং মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর মতো বিখ্যাত পণ্ডিতের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান। তাছাড়া তার কিছু বিখ্যাত চিঠি খুঁজে পেয়েছেন ইতিহাসবিদগণ, যেগুলো তিনি বাগদাদ থাকাকালীন মিশরীয় মামলুক শাসকদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। ১২৮০ কিংবা ১২৮২ সালে, পড়ালেখা শেষ করে মিশর থেকে সিরিয়া পৌঁছেন শিরাজি। সেখানে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ইবনে সিনার দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষা দিতে শুরু করেন। ১৩১০ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোটামুটি সুস্থ হয়েই তিনি তৎকালীন পারস্যের বর্তমান আজারবাইজানের অন্তর্গত তাব্রীজ শহরে গমন করেন। সেখানেই ১৩১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন কুতুবুদ্দিন শিরাজি।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে কুতুবুদ্দিন শিরাজির অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মধ্যযুগের অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতের মতো কোনো মৌলিক কাজ করেননি, কিন্তু এরপরও তাঁর সংকলন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার তাত্ত্বিক আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারেনি। আধুনিককালের অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে তার অনুপস্থিতির জন্যই এমন হয়েছে। কিন্তু, তার রচিত গ্রন্থগুলো তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মধ্যযুগীয় জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে আছে। তার মৃত্যুর পর সেগুলো নিয়ে কাজ করেছেন আরবের অনেক বিজ্ঞানী। সেগুলো ইতিহাসের দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ইউরোপেও।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে শিরাজির শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ 'নেহায়াত আল এদরাক'। এই গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের জ্যোতির্বিদগণের জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত কাজগুলোর যথার্থতা, সীমাবদ্ধতা, সীমাবদ্ধতার কারণ, বৈজ্ঞানিক ভুলসমূহ ইত্যাদি আলোচনা করেন। ১২৮১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, এখানে তিনি সমকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে গিয়ে 'হেলিওসেন্ট্রিজম' বা সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের সম্ভাব্যতা আলোচনা করেন।    

১২৮৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন 'দ্য রয়্যাল প্রেজেন্ট' যেখানে টলেমির গ্রহসমূহের গতি সংক্রান্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। এছাড়া 'এখতিয়ার আল মোজাফ্‌ফারি', 'ফি হারাকাত আল দাহরাজা', 'আল তুহফা আল সাহিয়া'সহ আরো বেশ কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন শিরাজি, যেগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

'রিসালা ফি হারকাত আল দারাজা' গ্রন্থটি শিরাজের জীবনের একমাত্র গণিতের বই। এই বইটিও ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। তবে মধ্যযুগীয় অনেক ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিকের উদ্ধৃতি থেকে যত দূর জানা যায়, এই গ্রন্থে ত্রিকোণমিতি এবং বীজগণিত বিষয়ক আলোচনা করেছেন শিরাজি। তার চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইগুলো অবশ্য টিকে আছে বর্তমান সময় পর্যন্ত। 'রিসালা ফি'ল বারা', 'রিসালা ফি বাইয়ান', 'আল তুহফাত আল সা'দিয়া'- কুতুবুদ্দিন শিরাজির চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক এই তিনটি গ্রন্থই মূলত ইবনে সিনার 'আল কানুন আল তিব' গ্রন্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এর মধ্যে, আল তুহফাত আল সা'দিয়া গ্রন্থটি প্রায় সম্পূর্ণটাই ইবনে সিনার চিকিৎসাশাস্ত্রীয় কাজের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা।

মধ্যযুগীয় সুফিবাদে শিরাজি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। এ বিষয়ে তার ছিল অগাধ জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। সুফিবাদের উপর তিনি রচনা করেছেন অনেকগুলো বই, যেগুলো মধ্যযুগে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

তিনি হয়তো কোনো মৌলিক কাজ করে যাননি, কিংবা কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণও সম্পন্ন করেননি। তবুও তিনি যা করেছেন, তা তার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে হাজারো পণ্ডিত এবং জ্ঞান সাধককে অনুপ্রাণিত করেছে। জীবনের ২৫-৩০টি বছর তিনি ব্যয় করেছেন জ্ঞানচর্চা করে। সুফিবাদের বাইরেও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে তার কাজগুলো মানুষ ভুলতে বসেছিল। তবে সাম্প্রতিককালের তাত্ত্বিকগণ কুতুবুদ্দিন শিরাজির কাজগুলো নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করেছেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদানের জন্য ইতিহাসে তার নাম চিরস্থায়ী হয়েই থাকবে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ