গল্প ও প্রবাদের গল্প:
অশ না খেয়েই গাল পুড়েছে
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা গল্প ও প্রবাদের গল্পের আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি প্রবাদের গল্প।
প্রবাদটি হল 'অশ না খেয়েই গাল পুড়েছে'। মজার ব্যাপার না! হুমম এর পেছনে রয়েছে চমৎকার একটি গল্প। গল্পটি এরকম: এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ছিল শৈল্পিক গুণসম্পন্ন। সে ছিল খুবই রন্ধনপটু। 'অশ' এক ধরনের ভেজিটেবল-নুডলস স্যুপ,যার মধ্যে কিডনি বিন, ছোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়ীর স্ত্রী এই অশ চমৎকারভাবে রান্না করতো। একেবারেই নজিরবিহীন বলা চলে তার রান্না করা অশ।
ব্যবসায়ীর পরিচিত মহল কিংবা আত্মীয় স্বজনের কাছে তার স্ত্রীর এই অসাধারণ অশ রান্নার বিষয়টি জানা ছিল। সবাই তাই মনে মনে চাইতো একটা দিন তার বাসায় আমন্ত্রিত হয়ে অশের স্বাদ উপভোগ করবে। এভাবে ধীরে ধীরে পুরো শহরে অশের বিষয়টি ছড়িয়ে গেল এবং ব্যবসায়ীর স্ত্রীর হাতের অশ রান্নার কথা শুনতেই সবার জিভে পানি এসে যেত। সবাই চেষ্টা করতে লাগলো ব্যবসায়ীর বন্ধু হতে। অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও চেষ্টা করতে লাগলো এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে লেনদেন করতে। গোত্রের লোকজন এবং স্বজনরাও চেষ্টা করলো তাকে কাছে টানতে এই আশায় যে, একদিন হয়তো তাদেরকে বাসায় অশ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবে। সেই সুবাদে ব্যবসায়ীর স্ত্রীর হাতের রান্না করা সুস্বাদু অশ খাওয়ার সুযোগ পাবে। ব্যবসায়ীর এক শাগরেদ ছিল ক'বছর হলো তার সঙ্গে কাজ করছে। সে যদিও গরীব ছিল তবে রুচি খারাপ ছিল না। কখনোই সে ব্যবসায়ীর বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর হাতের অশ খাবারের জন্য অজুহাত তৈরি করতো না। উল্টো বরং ব্যবসায়ী নিজেই শাগরেদকে বিভিন্ন কাজে বাসায় যেতে বলেছিল। কিন্তু শাগরেদ বিভিন্ন বাহানায় বাসায় যাওয়া থেকে বিরত থাকলো। একদিন সকালে ব্যবসায়ীর শাগরেদ যথারীতি ঘুম থেকে জেগে উঠলো। সেদিন তার দাঁত ব্যথা করছিল। তবু সে দোকানে গেল এবং দোকানের সামনে ভেতরে ঝাড়ু দিলো। চা বানালো এবং ব্যবসায়ীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো যাতে দৈনন্দিন কাজ শুরু করা যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ব্যবসায়ী এলো না। দুপুর হয়ে গেল তবু এলো না। অবশেষে তাদের এক প্রতিবেশির কাছ থেকে জানতে পারলো যে ব্যবসায়ীর শরীর ভালো নেই, অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রতিবেশি বললো: আমাকে বলেছে তোমাকে যেন বলি-দোকান বন্ধ করে ডাক্তার নিয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় যেতে।
শাগরেদ তাই করলো। দোকানের গেইট লাগালো। দ্রুত ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় গেল। ব্যবসায়ীর অসুস্থতার কারণে সে এতোই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে খেয়ালই করে নি এই দুপুরবেলা খাবারের সময় তার বাসায় যাওয়াটা ঠিক না। বাসায় যখন ঢুকলো দেখলো ব্যবসায়ী আহ..উহ করে তার অসুস্থতার কষ্টের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করলো এবং প্রেসক্রিপশন লিখে শাগরেদের হাতে দিলো। শাগরেদ কাছের আত্তারি মানে ভেষজ ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো বাসায়। ততক্ষণে ডাক্তার চলে গেল এবং ব্যবসায়ীর স্ত্রী খাবারের দস্তরখান বিছালো। শাগরেদ মনে মনে বললো: আজকে বোধ হয় আটকেই গেলাম। যতই বললো আপনার ওষুধগুলো এভাবে এভাবে খেতে হবে। বলেই সে চলে যাবার জন্য অজুহাত দাঁড় করালো। কিন্তু আজ আর কিছুতেই কাজ হলো না। ব্যবসায়ীর স্ত্রী ব্যাপক পীড়াপীড়ি করে তাকে আটকে রাখলো। বললো: খাবার সময় না খেয়ে যেতে দেবো না কিছুতেই। শাগরেদ শাগরেদ বিরক্তি সহকারে খেতে বসলো। ব্যবসায়ীর স্ত্রী তার স্বামীর জন্য যে সুস্বাদু অশ রান্না করেছিল তা একটা বাটিতে নিয়ে দস্তরখানে রাখলো। ব্যবসায়ী সেদিন পর্যন্ত শাগরেদকে কখনও তার বাসায় খেতে দেখে নি, তাই কম্বলের ভেতর থেকে মুখটা বের করে বললো: আমার বৌ যে অশ পাকিয়েছে, খাও! এই অশ জীবনে কোনোদিন খাও নি, পৃথিবীর কোথাও এরকম নজিরবিহীন অশ পাবেও না।
এই বলে আবার কম্বলের ভেতরে মুখ লুকিয়ে নিলো। শাগরেদ এ ধরনের কথা শোনার জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না, ভালো লাগে নি তার, বিরক্তই হলো। মনে মনে ভাবলো: দাঁতের ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে অশ না খেয়ে চলে যাবে। দাঁত ব্যথার মতো অভিনয় করলো সে। গালের ওপর হাত রেখে ব্যথাময় চেহারা বানিয়ে মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো কখন কম্বল থেকে আবার মুখ বের করে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীর স্ত্রী দু-তিনটি চামুচ আর প্লেট নিয়ে ফিরে এলো। চামুচগুলোকে দস্তরখানে রেখে তার স্বামীকে বললো: উঠে এসো! অশ খাও! অশ তোমার জন্য খুব ভালো। ব্যবসায়ী, বৌয়ের কথা শুনে কম্বলটা পাশে গুটিয়ে রেখে উঠে বসতে চাইলো।
ব্যবসায়ী চোখ মেলতেই তার মনে হলে শাগরেদ ভীষণ বিরক্ত। চোয়ালের ওপর হাত রেখে ব্যথার ভঙ্গি করে বসে ছিল সে। ব্যবসায়ী শাগরেদের দিকে তাকিয়ে বললো: তোমার কি মুখ পুড়ে গেছে? আহ হা! একুট ধৈর্য ধরলেই তো পারতে। অশ একটু ঠাণ্ডা হতো, তারপর খেলে তো আর মুখ পুড়তো না। ব্যবসায়ীর স্ত্রী এই কথা শুনে কিছুটা বিব্রতই হলো। স্ত্রী বললো: তুমি কী বলছো এসব! ও তো অশই খায় নি, মুখ পুড়বে কী করে? আমি সবেমাত্র চামুচ বাটি নিয়ে এসেছি। ও তো কিছুই মুখে দেয় নি, মুখ পুড়বে কী করে! ব্যবসায়ীর কথায় তার স্ত্রী যেমন বিব্রত হলো তেমনি বিরক্ত হলো শাগরেদও। শাগরেদ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। ব্যবসায়ী এবং তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো:
আমি খুবই দু:খিত! আমার দাঁত ভীষণ ব্যথা করছে। পরবর্তী সময়ে কখনও আপনাদের বাসায় অতিথি হয়ে এলে অবশ্যই আমি অশ ঠাণ্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। অশ ঠাণ্ডা করে খেলে তো আর গাল পুড়বে না। এই বলে শাগরেদ ব্যবসায়ীর বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেল। শাগরেদ চলে যাবার পর ব্যবসায়ী বুঝতে পারলো কীরকম ফুলের তোড়াই না সে পানিতে ফেলে দিলো মানে কী বাজে কাজটাই না করেছে সে। এই ঘটনার পর থেকেই কোনো অপরাধ না করার পরও কেউ যদি কাউকে অপরাধী বলে মনে করতো তখন তার ব্যাপারে বলতো: অশ না খেয়েই গাল পুড়েছে।#
পার্সটুডে/এনএম/৬
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ