সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ২৯
দাম্পত্য জীবনে কিছু সুঅভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সচেতনতা, প্রয়োজনীয় আন্তরিক পদক্ষেপ এবং পারস্পরিক ক্ষমা ও সহনশীলতার মধ্য দিয়ে অনেক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।
বিরক্তিকর সমস্যাগুলো স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অসচেতনতার জন্য যেমন- ছোট ছোট বিষয়ে খুঁত ধরা, পরস্পরকে সমাদর আদর-কদর না করা, সময়মত কিছু না করা, করা, পরস্পরের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, ঠিক সময়ে ঘরে না ফেরা, একে অন্যের সম্পর্কে কটু কথা বলা, সময়মত বাজার না করা, মোবাইলে লুকিয়ে বা এড়িয়ে কথা বলা, পরস্পরের কাজের সঠিক মূল্যায়ন না করা, পরস্পরের কাজের খোঁজ খবর না রাখা, অসুস্থতায় খেয়াল না করার মতো কিছু অভ্যাস আছে যেগুলো পরিহার করা জরুরি। এছাড়া সাধারণত আমাদের কথা ও আচরণে রুক্ষতা থাকে, সামান্য কিছুতেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বন্ধ করে থাকি, রান্না-বান্নার ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করে ফেলি-এগুলো দাম্পত্য জীবনে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায়। দাম্পত্য কহল এড়াতে চাইলে আমাদেরকে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা কেউই আমাদের সন্তানের অমঙ্গল চাই না। কিন্তু দাম্পত্য কলহ সন্তানের ওপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা সর্বজন স্বীকৃত। জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিল ইউনিসেফ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে- যেসব শিশু বাড়িতে হিংস্রতা দেখে, তাদের শেখার ক্ষেত্রে অসুবিধা হতে পারে এবং সীমিত সামাজিক দক্ষতার অর্থাৎ অন্যের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরণের শিশুরা হিংস্র ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা বা তীব্র দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে। আমাদেরকে আরেকটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, ছেলে আর মেয়েদের আচরণ ভিন্ন হয়ে থাকে। ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে আচরণ করতে হবে। ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় তাদের মর্মপীড়া আরো বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করে। তারা তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রমণাত্মক হতে পারে। তাদের মধ্যে অবাধ্য হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকতে পারে। কখনো কখনো তারা হিংস্রতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা শুরু করে দিতে পারে। এটা তাদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যেতে পারে যারা পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এ ধরণের হিংস্র আচরণ দেখে থাকে।
অন্যদিকে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা তাদের ভেতরে অস্থিরতা চেপে রাখে। অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এছাড়া মেয়েরা গুরুতরভাবে নিজেদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে এবং অস্পষ্ট শারীরিক উপসর্গের অভিযোগ করে। পরিবারে যারা হিংস্রতা দেখে বড় হয় তারা যথেষ্ট মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও স্কুলে পড়াশোনায় খারাপ করতে পারে। কারণ তারা নিজেদেরকে নিয়ে অনেক সন্দেহের মধ্যে থাকে এবং পারিবারিক বিবাদ তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে, তাই মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। একটা শিশুর পুরো পৃথিবী হলো তার মা-বাবা, তারাই বিশ্বজগতে তার জন্য কেন্দ্র, তাদের সম্পর্ক যদি স্থিতিশীল ও যুক্তিযুক্ত না হয়, সন্তানের জন্য কিছুই বিশ্বস্ত ও স্থিতিশীল থাকে না এবং সন্তানের নিরাপত্তার অনুভূতি মরে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় এক বছর বয়স থেকেই শিশু পরিবারের অশান্তি বুঝতে পারে। তবে শিশুদের চেয়ে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে। এমনকি বাবা-মা শিশুদের মিথ্যা বুঝিয়ে ঝগড়া থামানোর ঘোষণা দিলেও তারা এই মিথ্যা আচরণ সহজেই ধরতে পারে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার, অনেক শিশুই বাবা-মার ঝগড়া থামাতে নিজেই উদ্যোগী হয়, এটা শুধু তারা করে আতংকিত হয়ে, আর কিছু নয়।
কাজেই নিজের সন্তানদের ভালোর জন্য হলেও কিছু কাজ বাবা-মাকে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের পক্ষ থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুদের সামনে কখনোই বড় ধরণের ঝগড়া-ঝাঁটি করা যাবে না। তবে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও তা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধান করতে হবে। এর ফলে শিশুরা বুঝতে পারবে যেকোনো দ্বন্দ্বও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা যায়। যে কোনো ঝগড়ার সময় শিশু আশেপাশে থাকলে অনেক সময় তারা ভাবে, তাদেরই কোনো আচরণে বাবা-মা এরকম করছে। তাই যেকোনো ঝগড়া মিটে গেলে তাদেরকে অবশ্যই বোঝাতে হবে যে, তাদের কোনো দোষ ছিল না। আর বাবা-মায়ের এরকম ঝগড়া হয়ই, কিন্তু এটা সাময়িক মাত্র। এতে শিশুর ভিতরে একটা নিরাপত্তাবোধ গড়ে ওঠে। পরিবারের সব সদস্যের সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে এবং সব বয়সের সকলের জন্য ভালো থাকা নিশ্চিত করতে নেতিবাচক বিষয়গুলো ত্যাগ করা জরুরি।
পরিবারের অন্য সদ্যদের উচিত শিশুদের সঙ্গে খেলায় অংশ নেওয়া, তাদেরকে খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়া। কারণ খেলার মাধ্যমে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয় যা শিশুর কল্পনা শক্তি, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ বা ভাষার দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। গবেষকদের মতে, কথা বলার চেয়ে খেলার মাধ্যমে মানুষকে বেশি আবিষ্কার করা যায়। সন্তানের সঙ্গে খেলায় অংশ নিলে এবং সেই খেলা বুদ্ধির বিকাশ ও শারীরিক, সামাজিক এমনকি আবেগীয় কল্যাণে অবদান রাখে। শিশুদের প্রতি সহমর্মিতা হচ্ছে নিজেকে তার জায়গা থেকে বোঝা, তার চোখ দিয়ে দেখা, তার কান দিয়ে শোনা, তার হৃদয় দিয়ে বোঝা; অর্থাৎ তার জায়গা থেকে বোঝা ও অনুভব করা। শিশুর সাথে সহমর্মী হতে তার অনুভূতি ও ইচ্ছাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা, উদ্দেশ্য-চেষ্টাকে স্বীকৃতি দেয়া, জ্ঞান-বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দেয়া, সম্পর্কের স্বীকৃতি দেয়া, সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করা, বারবার অনুশীলন করা এবং সীমা নির্ধারণ করা জরুরি।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।