সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন- পর্ব ৩৩
যোগাযোগের ক্ষেত্রে শ্রবণের দক্ষতার প্রভাবের বিষয়টি সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ (সা.)'র জীবনাচারেও স্পষ্ট হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “মুনাফিকদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে সে তো কর্ণপাতকারী। বলে দিন, তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তাই শুনে। তিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন এবং মুমিনদের ওপর আস্থা রাখেন, তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন তিনি তাদের জন্য রহমতস্বরূপ, তবে যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।”
রাসূলে খোদা (সা.) যখন কারো সাথে কথা বলতেন তখন অত্যন্ত খোলা মন নিয়ে কথা বলতেন, প্রতিপক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, কাউকে অবজ্ঞা করতেন না, আল্লাহর রাসূলের এই উত্তম আচরণ নিয়ে মুনাফিকরা বিদ্রূপ করে বলতো এটা আবার কেমন পয়গম্বর! সহজ-সরল মানুষের মতই দেখি তিনি সবার সাথে কথা বলেন! মুনাফিকদের এই বিদ্রূপের জবাবে এই আয়াতেপাকে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা মহানবীর যে দিকটিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছো, আসলে তো তা একটি ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে আল্লাহর নবীর চারিত্রিক মাধুর্য্যতাই ফুটে উঠেছে। আল্লাহর নবীতো কোনো স্বৈরাচারী শাসক নন যে শুধু শাসন ও শোষণ করবে, অন্যকে অবজ্ঞা করে চলবে বরং আল্লাহর রাসূল মানবজাতির পথ-প্রদর্শক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাই বিনয় ও অনাড়ম্বর আচরণ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি উত্তম ও পরিশীলিত আচরণের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ইসলামী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের উচিত সাধারণ মানুষের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করা তাদের সুখ-দুঃখ, অসুবিধার কথা শ্রবণ করা। এটাই সঠিক আচরণ।
ইংরেজিতে দু'টি শব্দ আছে- হিয়ারিং ও লিসেনিং। এই দুই শব্দের বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে উভয় ক্ষেত্রেই শোনা বা শ্রবণ করা লেখা হয়। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছ। শ্রবণশক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না আমরা, যেকারণে যেকোনো শব্দ বা আওয়াজই আমাদের কানে বাজে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা শুনছি অর্থাৎ শ্রবণ ইন্দ্রিয় চাইছে বলেই শুনছি- এমন শোনাকে হিয়ারিং বলা হয়। কিন্তু লিসেনিং আরও বিস্তৃত। লিসেনিং বলতে যে শ্রবণকে বোঝানো হয় তার সঙ্গে মন ও হৃদয়েও সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয় এর সঙ্গে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাও জড়িত। এই শ্রবণের সঙ্গে কেবল শ্রবণ ইন্দ্রিয় যুক্ত নয়, অবৈজ্ঞানিক ও অলিখিত হৃদয় দিয়ে কথাকে অনুভব করা। আমরা শ্রবণ বলতে এ ধরণেরই শ্রবণকেই বোঝাচ্ছি। এই শ্রবণ হচ্ছে এক ধরণের দক্ষতা। আমরা অনেকেই মনে করি শ্রবণে আমরা খুবই দক্ষ। আমরা এমন ধারণাও করি যে, আমরা শ্রবণ দক্ষতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সবাই সঠিক উপায়ে এটাকে ব্যবহার করি না, উপযুক্ত পন্থায় শ্রবণ করি না। দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভালোভাবে শ্রবণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বেশিরভাগ ঝগড়াঝাঁটির কারণ হচ্ছে পরস্পরের বক্তব্যকে সঠিকভাবে উপলব্ধি না করা অর্থাৎ মন ও হৃদয় দিয়ে কথা না শোনা।
মনে রাখতে হবে, সক্রিয় ও সচেতনভাবে শুনতে সক্ষম হওয়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। কিন্তু এই দক্ষতার বিকাশ ঘটানোকে সাধারণত উপেক্ষা করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, আমরা সাধারণত অন্য ব্যক্তি কী বলছে তা শোনার চেয়ে তারা কী বলতে চায় তার প্রতি আরও বেশি মনোনিবেশ করি। এর ফলে অনেক পরিস্থিতিতেই ব্যক্তির কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অন্য ব্যক্তিকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য কখন বিরতি দিতে হবে তা জানাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। মজার বিষয় হলো, কথা ভালো বলতে পারেন এমন মানুষও কথা শুনতে খুব বেশি দক্ষ হন না। আরেকজন লোক কী বলছে বা কী রকম অনুভব করছে তা আমাদের শোনা উচিত। অন্যের কথা কথা শোনার বদলে বেশিরভাগ লোকজন আগেই জবাব তৈরি করে ফেলেন। ভালো করে অন্যের কথা শোনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় জরুরি, সেগুলো মেনে চলা উচিত।
যখন অন্য ব্যক্তির কথা শুনবেন তখন অবশ্য তার প্রতিটি শব্দ খেয়াল করবেন এবং গলার স্বর ও দেহের ভাষার দিকে নজর রাখবেন। কোনো সমস্যা থাকলে কখনও কখনও কথা বলতে শুরু করা বেশ কঠিন। অনেক সময় কথার মধ্যের শুধু শব্দগুলো শুনে বুঝা যায় না অপর মানুষটি কোনো সমস্যার মধ্যে আছে কিনা। তার গলার স্বর কি কাঁপছে? "সঠিক শব্দ" খুঁজে পেতে কি তার কষ্ট হচ্ছে? তার শরীরে কি টেনশন বুঝা যাচ্ছে? তাকে দেখে কি মনে হচ্ছে সে অন্য কিছু ভাবছে? যদি এসব লক্ষণ আপনি দেখতে পান তবে বুঝতে হবে সে যেটুকু কথা বলছে তার চেয়ে তার মনের মধ্যে আরা বেশি কথা রয়েছে। ধরুন আপনি কারো কথা শুনছেন তখন অবশ্যই তাকে ঐ তথ্যটি জানাতে ভুলবেন না। ঐ ব্যক্তিটিকে জানান যে, আপনি তার কথা শুনছেন। শুধু "উহ বা আহ্" বলেও এটা বুঝানো যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ চায় অন্যেরা তার কথা শুনছে। অনেকেই চান অন্তত একজন কেউ তার কথাটা শুনুক। কারণ কখনও কখনও সমব্যথী কারো সাথে কথা বলাটাই অনেক উপকারে আসে।
যার কথা শুনছেন তার সমস্যাটির বিষয়বস্তু বুঝতে পারার পর তাকে তা অবহিত করুন। ব্যক্তিকে জানান যে, আপনি সমস্যাটার সারবস্তু এবং এর সাথে জড়িত আবেগের মাত্রা বুঝতে পেরেছেন। আপনি যা শুনেছেন তার মূলকথা নিজের মুখে আবার বলে তাকে এটা বুঝাতে পারেন। আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে জবাব দিলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ধরনের জবাব আরো আবেগ-অনুভূতি বা চিন্তা-ভাবনার দরজা খুলে দেয়। বিষয়বস্তু বা আবেগের ভিত্তিতে জবাব দিলে তা যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। আপনি যখন কারো কথা সচেতনভাবে শুনবেন তখন তাকে তা বোঝানোর চেষ্টা করুন। কথা শোনার পর আরো তথ্য জানতে চান। এটা তখনি বিশেষভাবে জরুরি যখন আপনি বুঝতে ব্যর্থ হবেন যে, কি বলা হয়েছে বা কি চাওয়া হচ্ছে।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।