এপ্রিল ০১, ২০২৩ ১৬:৪৬ Asia/Dhaka

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য যে চিঠি দিয়েছে সে বিষয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলছে। চায়ের কাপে ঝড় উঠছে। এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন 'আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টির' সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু্।

তিনি বলেছেন,বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল যারা আছেন তারা যদি চান তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনো পথ বের করা সম্ভব। যেমনটি বের হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সুতরাং আমি মনে করি যে সমাধান একটাই। সেটি হচ্ছে ১৯৯০ সালে জোটের  যে রুপরেখা ছিল সেই রুপরেখার আলোকে একটি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্য কোনো নামে অন্তবর্তীকালীন সরকার কিংবা জাতীয় সরকার এভাবে যেকোনো একটা নাম দিয়ে সেই সরকারের অধীনে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচন হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সহমর্মী একটা পরিবেশ ফিরে আসবে। আর তা নাহলে এখানে সংঘাত হবে এবং তার পরবর্তী পরিণতি কারও জন্যে ভালো হবে না! একটা ভয়াবহ অন্ধকার যুগে দেশ প্রবেশ করবে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম। উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: নির্বাচন কমিশন সংলাপের জন্য বিএনপিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি তাতে সাড়া দেবে না বলে জানিয়েছে। আপনার কী মনে হয়- এই সংলাপে বিএনপি সাড়া দিলে চলমান সঙ্কটের একটা সমাধান আসতে পারতো?

নির্বাচন কমিশন

মজিবুর রহমান মঞ্জু: ধন্যবাদ, দেখুন নির্বাচন কমিশন সংলাপের জন্য বিএনপিকে যে আহ্বান করেছে দলটি বলেছে এটি সরকারের একটি নতুন কৌশল। আসল কথা হচ্ছে অতীতে আমাদের যে নির্বাচনগুলো হয়েছে সবগুলোতে আমরা দেখেছি-নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাটা তখনই মূখ্য হয় যখন সরকার একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে। অন্যদিকে সরকার যদি দলীয় অবস্থানে থাকে তাহলে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচই স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠুভাবে হয়নি। বরং আমরা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আমরা যে তিনটি নির্বাচন দেখেছি সেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখতে পেরেছে। আর সেই তিনটি নির্বাচন নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বিতর্ক হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি নির্বাচনের কমিশনের চিঠির পর বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে সেটি তাদের আন্দোলনের সাথে সহায়ক। কারণ বিএনপি বারবারই বলছে নির্বাচন কমিশন নয় বরং সরকার নিরপেক্ষ হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি কেন নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে যাবে? এটা তো কোনো মূখ্য  আলোচ্য বিষয় নয়। যখন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার  কিংবা নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে তখন যদি নির্বাচন কমিশন কোনো সংলাপের  আয়োজন করে সেটি অর্থবহ হবে।

রেডিও তেহরান: মির্জা ফখরুল বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কিছু করার কোনো ক্ষমতা নেই। এজন্য তারা সংলাপে যাবেন না। যদি এই অভিযোগ সত্য হয় তাহলে প্রশ্ন আসছে- কে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাহীন করল? আর কী করলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে?

আওয়ামী লীগ-বিএনপি

মজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিহীন করার জন্য কে দায়ী এ প্রশ্নের জবাবে আসলে বলতে হয় স্বাধীনতা পরবর্তীতে যে তিনটি দল বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই তিনটি দলই এজন্য দায়ী এবং তারা অ্যালাই ছিল। তারা প্রত্যেকে যতবারই ক্ষমতায় এসেছেন ততবারই রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভ বা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তারা রাষ্ট্রীয় স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে দলীয় আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। আর এই দায় থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি কেউ মুক্ত নয়। সুতরাং আমি মনে করি নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জায়গাটা আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখেছি আপনারও মনে থাকার কথা। আমরা দেখেছি যে কেয়ারটেকার সরকারের আমলে তারা যখন দায়িত্ব নেয় তখন পুরো প্রশাসনে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়, সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্তদের তারা গ্রেপ্তার করে এবং মানুষের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করে যে হ্যাঁ একটা প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার জায়গা এখানে তৈরি হয়েছে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে একটা ছন্দ ফিরে আসে। আর এ কারণেই নির্বাচন কমিশন তাদের স্বাভাবিক শক্তি ফিরে পায়।

আমাদের নির্বাচন কমিশন আইনে আছে, নির্বাচন চলাকালীন সময়ে প্রশাসন, থানা পুলিশ সবাই নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। আর এটি তখনই কার্যকর করা সম্ভব যখন ক্ষমতাসীন সরকার এখানে হস্তক্ষেপ না করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা দেখেছি যে তাদের এই হস্তক্ষেপটা থাকে না। কেয়ারটেকার সরকারের সময় নির্বাচন পরিচালনার যে সময়টা আমরা দেখেছি সেই সময়ের প্রতিটি ধাপ-অর্থাৎ তপসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে খুবই শক্তিশালী রূপে।

সুতরাং নির্বাচনের জন্য সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা লাগবে নির্বাচন কমিশনের। আমাদের এ সম্পর্কিত যে আইন আছে সেখানে সামান্য হয়তো পরিবর্তন লাগবে তাছাড়া সরকার যদি নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও নির্দলীয় হয় তাহলে অবশ্যই নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হবে।

শ্রোতাবন্ধুরা! আলাপন অনুষ্ঠানে বিএনপিকে নির্বাচন কমিশনের চিঠি দেয়া নিয়ে এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু'র সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি। আমাদের সঙ্গেই থাকুন।

রেডিও তেহরান:  আবার ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে, জনাব মঞ্জু বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর এক বছরের কম সময় হাতে আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো সমঝোতা হলো না। তাতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? অনেকেই কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক সংঘাতের আশংকা করছেন।

মজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তো অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন দেখেছি। এরপর আমরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনও আমরা দেখেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কোনো বিরোধী দল অংশ নেয়নি। সেখানে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা দেখেছি যে প্রায় দেড় শতাধিক কেন্দ্রে একটা ভোটও পড়েনি। বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখেছি মানুষের উপস্থিতি ছিল না। জনশূন্য সেখানে ছিল গৃহপালিত জন্তু।

আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা দেখেছি একটা সমঝোতা একটা আলোচনার পথ ধরে বিদেশিদের দুতিয়ালিতে সবাই অংশ গ্রহণ করেছেন কিন্তু দেখা গেল যে বিরোধী দলকে মাঠেই নামতে দেয়া হয়নি। শুধু তাই না নির্বাচনের আগের রাতে শতকরা ৯০ ভাগ ভোট কাস্ট করে নেয়া হলো। সুতরাং বাংলাদেশের নির্বাচনে সমঝোতা এবং একক নির্বাচনের যে পরিস্থিতি এবং এর ফলাফল আমরা একইরকম দেখেছি। সেজন্য আমি মনে করি যে সমঝোতায় আসা যেতে পারে একটি জায়গায় যেটি হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ১৯৯০ সালে একটি গণঅভ্যুত্থান পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ততকালীন ক্ষমতাসীন সরকার রাজি হয়েছিল যে তারা কীভাবে ক্ষমতা ছেলে একটা কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পন করবেন। তখন একটা সাংবিধানিক পদ্ধতি বের করা হয়েছিল।

দেখুন, বারবার বলা হয় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা নেই কিংবা সংবিধানে এ বিধান নেই। কিন্তু বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল যারা আছেন তারা যদি চান তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনো পথ বের করা সম্ভব। যেমনটি বের হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সুতরাং আমি মনে করি যে সমাধান একটাই। সেটি হচ্ছে ১৯৯০ সালে জোটের  যে রুপরেখা ছিল সেই রুপরেখার আলোকে একটি নিরপেক্ষ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্য কোনো নাম অন্তবর্তীকালীন সরকার কিংবা জাতীয় সরকার এভাবে যেকোনো একটা নাম দিয়ে সেই সরকারের অধীনে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচন হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সহমর্মী একটা পরিবেশ ফিরে আসবে। আর তা নাহলে এখানে সংঘাত হবে এবং তার পরবর্তী পরিণতি কারও জন্যে ভালো হবে না! একটা ভয়াবহ অন্ধকার যুগে দেশ প্রবেশ করবে।

রেডিও তেহরান: গত দুটি নির্বাচনে বাইরের কোনো কোনো দেশের হস্তক্ষেপ ছিল খুবই নগ্ন এবং বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে তা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে- এমন অভিযোগ করেন বিশেষজ্ঞ মহলের অনেকেই। প্রশ্ন হচ্ছে- আগামী নির্বাচনেও কী এমন হস্তক্ষেপ হতে পারে?

মজিবুর রহমান মঞ্জু:  আপনি যেটি বললেন সেটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যেমনটি বললেন সেটাই কিন্তু সত্য। কিন্তু আমরা রাজনীতিবিদরা এগুলোকে এড়িয়ে যাই কিংবা অস্বীকার করি। তবে একথা সত্য যে আমাদের এখানে বিদেশি শক্তি বা আমাদের উন্নয়ন সহযোগি যেসব রাষ্ট্র আছে, বন্ধু রাষ্ট্র আছে তাদের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আমরা দেখতে পাই। ২০১৪ কিংবা ২০২১৮ সালের নির্বাচনে আমরা দেখেছি যে আমাদের প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পরবর্তী ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটল!

ভোট

গতবারের নির্বাচনেও আমরা দেখেছি, এরকম একটা অনৈতিক নির্বাচনকেও কেউ কেউ সমর্থন দিয়েছেন। পররবর্তীতে সরকারকে তারা সাধুবাদ জানিয়েছেন। আমি মনে করি এবারের প্রসঙ্গটি অনেকটা পরিবর্তিত। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বন্ধু রাষ্ট্র কিংবা সহযোগী রাষ্ট্রগুলো একটা কনসার্ন শো করেছেন যে তারা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও একটা অর্থবহ নির্বাচন তারা বাংলাদেশে দেখতে চায়। সুতরাং আমি মনে করি যে বিদেশি শক্তিরা যদি বাংলাদেশে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে থাকেন তাহলে এদেশের মানুষের যে বন্ধু ভাবাপন্ন যে আচরণ সেটি থাকবে। আর যদি কোনো রাষ্ট্র এদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা বিপন্ন হওয়া, রাজনীতি বিপন্ন হওয়াকে সমর্থন করেন তাহলে দেশ এবং জনগণের কাছে সেইসব রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের ভাবমূর্তিটা ক্ষুণ্ণ হবে। আমি কিন্তু আশাবাদী মানুষ। আমি আশা করি যে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো, উন্নয়ন সহযোগি রাষ্ট্রগুলো এবারে অন্তত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবেন এবং তারা বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হবেন। আর যদি তারা বুঝতে সক্ষম না হন তাহলে বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণা এবং ক্ষোভ নিয়ে তাদেরকে থাকতে হবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মজিবুর রহমান মঞ্জু : ধন্যবাদ আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্রোতাদেরকে অভিনন্দন। #

পার্সটুডে/জিএআর/১

ট্যাগ