মে ০১, ২০২৩ ২২:৪৭ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর তৎপরতা, দেশের ভেতর নানা আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক, বাংলাদেশে ডিফেন্স জার্নাল পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আবু রুশদ রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের দেশে আমেরিকাসহ কোনো দেশ গণতন্ত্র চাইলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এটি আসলে ঠিক না।

প্রধানমন্ত্রী আমেরিকাকে নিয়ে কথা বলেছেন। বিষয়টিকে আমি এভাবে বলব, শেখ হাসিনা নির্দ্বিধায় একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর ঐ বক্তব্যকে আমি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে দেখতে পারি  আবার এটাকে একটা ইঙ্গিত হিসেবেও দেখতে পারি।

আবু রুশদ বলেছেন, ওয়ান ইলেভেন আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, রাজনৈতিক অঙ্গনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায় ততকালীন সরকারের জন্য ক্ষতি হয়েছিল তবে রাজনৈতিকভাবে কিন্তু আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছে। বিএনপির সে সময়কার ভুলটা যদি তারা বুঝতে পারে এবং আমেরিকাও তাদের ভুল থেকে সরে গিয়ে তারা যদি আমাদের দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায় সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে স্বাগত জানাতে হবে। আমাদের গণতন্ত্রের জন্য যে দেশই উদ্যোগ নিক না কেন তাকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে।

সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কিত আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, গতপর্বের শেষ প্রশ্নটি ছিল- যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকা সফর করছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন যে আমেরিকা চাইলে যেকোন দেশে সরকার পাল্টে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী কেন এই বক্তব্য দিলেন এবং তিনি কোন কিছু আশঙ্কা করছেন কিনা? আপনি এর জবাবে বলছিলেন আমেরিকা তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি.. সেই আলোচনা  কিন্তু শেষ করা যায়নি। সেখান থেকেই শুরুর আহবান জানাচ্ছি।

আবু রুশদ: দেখুন, আমেরিকানরা অবশ্যই পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি। তারা চাইলে হয়তো অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমেরিকা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করেছে বলে তো আমি মনে করি না। তারা আমাদের দেশে গণতন্ত্র চাচ্ছে। এখন কেউ যদি মনে করে যে এটা বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম বা অন্য দলকে ফ্যাসিলেডেট করছে-আর সেজন্য আমেরিকার বিরুদ্ধে বলতে হবে, সেটাতো আসলে ঠিক না। এখন শেখ হাসিনা নির্দ্বিধায় একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর ঐ বক্তব্যকে আমি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে দেখতে পারি  আবার এটাকে একটা ইঙ্গিত হিসেবেও দেখতে পারি। তবে এটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন।

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, আপনি বললেন যে, আমেরিকা তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই অনেক বক্তব্য আছে বা বিশ্লেষকদের অনেকেই বলে থাকেন যে, ওয়ান ইলেভেনের যে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে তার সাথে পশ্চিমা জগতের একটা বড় সম্পর্ক ছিল এবং সে কারণে পরিবর্তনগুলো হয়েছে। আর ওয়ান ইলেভেনকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী একটি ইস্যু মনে করা হয়। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবু রুশদ: দেখুন, ওয়ান ইলেভেন আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, রাজনৈতিক অঙ্গনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমি এটাকে কখনও সমর্থন করিনি। সেই সময় আমি দৈনিক পত্রিকায় ছিলাম এবং বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করেছি, লিখেছি। ব্যাপারটা দেখুন, ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনে যখন টুইন টাওয়ার অ্যাটাক হয়েছিল তারপরের বিশ্ব প্রেক্ষিতটা আপনি একটু চিন্তা করুন। বাংলাদেশে তখন বিএনপি বা চারদলীয় জোট সরকারে ছিল। সে সময় বাংলাদেশের একটার পর একটা ঘটনা ঘটছিল। সেইসব ঘটনাকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। যেমন ধরুন দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার। সিরিজ বোমা হামলা, ২১ শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এসব বিষয় কিন্তু একটা অকার্যকর সরকারের প্রমাণ দেয়। সে সময় বিএনপি সরকার বন্ধুহীন হয়ে পড়ছিল। তারা কূটনৈতিক বিষয়সহ বেশ কিছু বিষয় ঠিকভাবে চালু রাখতে পারেনি। তখনকার প্রেক্ষিতে তারা একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিল।

রাশিয়ার কথা ধরেন। তারা ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। এটি তাদের নিরাপত্তার একটা ভীতি থেকে করেছে। যদিও এটাকে আমি আগ্রাসন বলব। ঐসময় নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকাও একটা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে ছিল। সেটা তারা করেছে। আর এরজন্য তাদের ক্ষতি হয়েছে।

সেসময় বাংলাদেশে ক্ষতি হয়েছে ততকালীন সরকারের জন্য ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায়। তবে রাজনৈতিকভাবে কিন্তু আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছে। তবে বিএনপির সে সময়কার ভুলটা যদি তারা বুঝতে পারে এবং আমেরিকাও তাদের ভুল থেকে সরে গিয়ে তারা যদি আমাদের দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চায় সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে স্বাগত জানাতে হবে। আমাদের গণতন্ত্রের জন্য যে দেশই উদ্যোগ নিক না কেন তাকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। আবার যদি কোনো দেশ সে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে কি করেনি কিন্তু এখনকার প্রেক্ষিতে যদি আমাদের জনগণের আশা-আকাঙ্খা, কিংবা আমাদের জনগণের অধিকারের বিপক্ষে যায়, একটি ফ্যাসিবাদের পক্ষে কথা বলে সেটাকে আমরা প্রতিবাদ করব। আমাদের বেজ লাইনটা এখানে ঠিক করা দরকার।

শ্রোতাবন্ধুরা! বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আবু রুশদের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব আবু রুশদ, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। যেখানে সরকারের সাথে বিএনপি'র বা আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি'র বৈঠক হওয়ার কথা সেখানে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখছি। এটি কেন এবং কতটা গ্রহণযোগ্য বিষয়টি? আর বিএনপির অবস্থান ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা এতে?

আবু রুশদ: দেখুন, এগুলো আসলে মেনে নেয়া কষ্টকর। ছোট কিংবা বড় যেকোনো দেশের অভ্যন্তরে এধরনের ঘটনা মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টকর। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এগুলো মেনে নিতে আমার কষ্ট হয়। কেন আমাদের নিজেদের বিষয়গুলো আমরাই ম্যানেজ করতে পারছিনা। আমাদের দেশের বয়স প্রায় ৫২ বছর হয়েছে। আয়তনে ছোট হলেও আমাদের দেশের মানবসম্পদে অনেক বড় দেশ। তারপরও বাস্তব বলে কতগুলো কথা আছে। আমরা আসলে আমাদেরকে যোগ্য প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা।

আপনিও একজন সাংবাদিক, আপনারও মনে থাকার কথা-যে ১৯৯১ সালের পর আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিদেশিদের কাছে ধর্না দিতেন। প্রতিটি বিষয়ে ধর্ণা দিতেন।মানবাধিকার কিংবা নারী অধিকার বিষয়ে বলেন যেকোনো বিষয়ে ততকালীন বিএনপিকে সরকারকে একদিনের জন্য শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না এ ধরনের কথাবার্তা তখন বলা হয়েছে। ১৭৩ দিন হরতাল করা হয়েছে। ২০০১ সালের পর আমি তখন দৈনিক পত্রিকায় ছিলাম। তখন বৃটিশ হাইকমিশনার ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ওপেনলি বৈঠক করতেন। কথিত সুশীলরা বৈঠক করতেন। এই ধারাবাহিকতাগুলো তো আমাদের আছে!

রেডিও তেহরান: জনাব আবু রুশদ, সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ দিকে চলে এসেছি। আপনি বলছিলেন- বিদেশিদের সাথে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার একটা ধারাবাহিকতা কিন্তু আমাদের আছে, তো এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

আবু রুশদ: দেখুন, এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এমন একটা অবস্থা যে আমরা নিজেরা নিজেদেরকে মেইনটেইন করতে পারছি না। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছিনা। সামাজিকভাবে একে অন্যকে অস্থির করে তুলেছে। বিএনপি আওয়ামী লীগ কিংবা আওয়ামী লীগ বিএনপি- কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। আর এই পরিস্থিতিটা আমরা তৈরি করেছি। এখন কেউ যদি এখানে একটি ভূমিকা পালন করে তাহলে তাকে কী আমরা দোষ দিতে পারব?

কেউ যদি আমাদের সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হয় বিশেষ করে আমাদের মতো দেশ, আমরা তো অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। আজকে দেখেন তারা যদি আমাদের গার্মেন্টস নেয়া বন্ধ করে দেয়, জাতিসংঘে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নেয়া বন্ধ করে দেয় তখন আমরা কি করব! আমাদের কী আছে, আমাদের এমন কোনো খনিজ সম্পদ বা বিশেষ কিছু কী আছে যা দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারব। ইরান বা সৌদি আরবের কথা ধরেন। তাদের তো তেল আছে। তারা টিকে থাকতে পারছে। আমরা কী দিয়ে টিকে থাকব! আমাদেরকে কিছুটা হলেও এই সব চিন্তার জায়গা থেকে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় আমাদের নিজেদের স্বার্থে।

এখানে আপনি বিএনপির যে কথা বললেন, বিএনপি একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম, গণতন্ত্র আানার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, যে যত কথা বলুক না কেন? বিএনপির অনেক দুর্বলতা আছে। এখন বিএনপিকে কী যথেস্ট হেনস্তা করা হয়নি? তার দলীয় নেত্রীকে কি অপমান অপদস্ত  করা হয়নি, জেলে নেওয়া হয়নি? বিএনপি এদেশে গণতন্ত্র চায়। বিএনপি এদেশে কখনও জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করেনি যদিও তাদের অদক্ষতা আছে। সেকারণে আমি মনে করিনা এটি চাওয়া বিএনপির জন্য কোনো দোষের বিষয়। এভাবে যদি একটি সমস্যার সমাধান হয়, দুজনকে এক টেবিলে আনা যায় এবং একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে অসুবিধা কোথায়!

রেডিও তেহরান: তো জনাব আবু রুশদ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং এ বিষয়ে বিভিন্নমহলের তৎপরতা, বক্তব্য, আলোচনা এবং বাস্তবতা নিয়ে দুই পর্বে চমৎকার আলোচনা করার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১

 

ট্যাগ