সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ৩৫
কেউ যখন আমাদের সঙ্গে তার দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করেন তখন তাকে উপদেশ দেবেন না। শুধু উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকলেই চলবে না তার বক্তব্যের বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়াও ঠিক হবে না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা কোনো কোনো সময় এমনটা করে ফেলি।
যিনি দুঃখ-বেদনা শেয়ার করছেন তাকে আমরা না বুঝেই নসিহত করতে শুরু করি এবং তার ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করতে থাকি। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, যিনি আপনার সঙ্গে তার কষ্ট শেয়ার করছেন তিনি আপনার কাছে কোনো পরামর্শ চাইতে আসেননি, তিনি চাইছেন তার কষ্ট ও উদ্বেগ আপনার সঙ্গে শেয়ার করে একটু হালকা হতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই বুঝতে পারে তার অবস্থান সঠিক নাকি বেঠিক। এ ক্ষেত্রে তাকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষকরে কেউ যখন কষ্টে থাকেন তখন তাকে এ ধরণের উপদেশ দেওয়া অনুচিত।
সহমর্মিতা ও সহানুভূতির অনুশীলনটা শিশুকাল থেকেই শুরু হওয়া জরুরি। ছোটবেলা থেকে এমন শিক্ষা পেলে সন্তান সহনশীল হয়ে উঠবে এবং অন্যের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে শিখবে। যারা শিশুকালে অন্যের দুঃখে দুঃখ অনুভব করতে শেখে না, তারা বড় হয়ে অন্যের সহমর্মী হতে পারে না সহজেই। বড়দের দেখেই অনেক কিছু শেখে ছোটোরা, আশেপাশের লোকজন অন্যের বিষয়ে সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হলে শিশুরাও সেরকম হওয়ার চেষ্টা করে। সন্তানদের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সহানুভূতির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
প্রতিটি মানুষেরই যে অন্যের বিষয়ে কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে সেসব বিষয় যুক্তিসহ বুঝাতে পারলে ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসকদের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। তারা শিশুকে বয়স অনুযায়ী বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝাতে পারেন। সুসম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় মেনে চলা জরুরি আর তাহলো অন্যের অনুভূতিকে নির্বিঘ্নে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া। এর ফলে ঘনিষ্ঠতা যেমন গাঢ় হয় তেমনি পারস্পরিক আস্থা বাড়ে। তবে সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হওয়ার জন্য নিজের অনুভূতি সম্পর্কে জানাটা জরুরি।
নিজেদের আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে যারা সচেতন তারা সহজেই অন্যের আবেগ-অনুভূতি ধরতে পারেন এবং সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হন। মনে রাখবেন কোনোভাবেই অন্যের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না এবং সহমর্মিতা যাতে কখনোই মেকি না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। আপনার সঙ্গে যিনি তার কষ্ট ও সমস্যা শেয়ার করছেন তাকে বোঝান যে, আপনি সত্যিই তার প্রতি সহমর্মী এবং তার সমস্যার কথা অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে ঐ ব্যক্তি অপমানবোধ করতে পারেন এবং আপনার প্রতি তার আস্থা উঠে যেতে পারে।
সমবেদনা বা সহমর্মিতা প্রকাশের সময় তা এমনভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে ব্যক্তি নিজের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করে। তার মধ্যে যাতে এমন অনুভূতি সৃষ্টি যে, তার কষ্ট বোঝার মতো কেউ একজন আছেন এবং সমস্যায় পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন তিনি। যিনি আপনার সঙ্গে সমস্যা শেয়ার করছেন তাকে বোঝান যে, আপনি তার আবেগ-অনুভূতি শুনে বিরক্ত হচ্ছেন না। এর ফলে পরবর্তীতেও আপনার সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশে আগ্রহী হয়ে উঠবে শোকাহত ব্যক্তি।
সহানুভূতি প্রকাশের সময় শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে। সমস্যাটাকে বেশি বড় বা বেশি ছোট হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। অনেকেই কথা শুনতে শুনতে বলে ফেলেন, তুমিতো মহা সমস্যায় পড়ে গেছ অথবা এটাতো কোনো সমস্যাই না। সহমর্মিতার কিছু অনুশীলন করা যেতে পারে। আপনি কোনো একটা সময় বাছাই করে তখন নিজের জন্য এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করুন যাতে নিজেকে খুব একা মনে হয়। এই অবস্থায় অন্যদের কাছ থেকে কী ধরণের প্রতিক্রিয়া আপনি প্রত্যাশা করছেন তা লিখে রাখুন। কী ধরণের কাজ করলে আপনি খুশি হবেন, কী ধরণের কথা বললে আপনার ভালো লাগবে সেগুলো লিপিবদ্ধ করুন। এভাবে আপনি নিজেকে অন্যান্য অবস্থানেও চিন্তা করে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া লিখে রাখতে পারেন। এর ফলে আপনি বুঝতে পারবেন অন্যেরা সমস্যায় পড়লে আপনার কাছে কী ধরণের আচরণ প্রত্যাশা করে।
সমস্যা ও সংকটে নিজেকে অন্যের অবস্থানে বসাতে পারার সক্ষমতা আপনার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে আপনি অন্যের সমস্যা সমাধানে আগের চেয়ে আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারবেন। অন্যের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসাতেও এটা কাজে আসবে।
বহু গবেষণায় দেখা গেছে, খুব সাধারণ দুই-একটি শব্দ ও বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমেও অন্যের মনের অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলা যায়। যিনি আপনার সঙ্গে তার সমস্যা শেয়ার করছেন তাকে যদি আপনি বলেন, 'তোমার অবস্থাটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি', 'চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে', 'আল্লাহর ওপর ভরসা করো', 'এই সমস্যাটা হয়তো তোমার জন্য একটা পরীক্ষা, তুমি এই পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে উত্তীর্ণ হবে' তাহলে দেখবেন ঐ ব্যক্তির মনের অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এমন পরিস্থিতিতে আশাবাদী করে তুলতে পারাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশাহত ও শোকাহত মানুষের সঙ্গে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। এর ফলে মানব জীবন আরও সুন্দর ও সুখময় হয়ে ওঠে।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।