রংধনু আসর
ধৈর্য: সৌভাগ্যের জিয়নকাঠি
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে আবারো হাজির হয়েছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। এটি এমন একটা গুণ, যার কারণে সে অসুন্দর ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূল এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে বলেন, "অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।" (৪৬:৩৫)।
শত্রু ও বিরোধীদের মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ধৈর্য। মহান আল্লাহ বলেন, "তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকি হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।" (৩:১২০)।
ধৈর্যশীলদেরকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে কুরআনের সুরা লুকমানের ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে আমার প্রিয় বৎস, নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’
মহানবী (সা.) যখন আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করছিলেন তখন মক্কার বিধর্মীরা তাকে তা থেকে বিরত থাকতে প্রলোভন দেখাল। এতে কাজ না হওয়ায় ভয়ভীতি প্রদর্শন এমনকি অকথ্য নির্যাতনও চালাল। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করায় ইসলামের অনুসারী দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল। এ অবস্থায় মক্কার কাফিররা ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে সামাজিকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিল।
তারা মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীদের সঙ্গে ওঠা-বসা, বেচাকেনা, লেনদেন এমনকি খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে অবরোধ আরোপ করল। এ ধরনের দুর্দিনেও রাসুলুল্লাহ (সা.) ধৈর্য হারাননি, বরং তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব সহ্য করে গেলেন। পরে কুরাইশরা নিজেদের ভুল বুঝে তাদের বর্জননীতি প্রত্যাহার করে নেয়।
বন্ধুরা, ধৈর্য সম্পর্কে এত কথা বলার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছো! হ্যাঁ, আজকের আসরে ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব। তারপর থাকবে ধৈর্য শক্তি বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে কয়েকটি টিপস। সবশেষে শুনবে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন সহকর্মী আশাফুর রহমনান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে ঘটনা দুটি শোনা যাক।
হযরত লোকমান (আ.) ছিলেন আগেকার দিনের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি লোকমান হাকিম নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। 'হাকিম' মানে জ্ঞানী, পণ্ডিত, প্রাজ্ঞ ও মনীষী। তিনি ছিলেন দাউদ (আ.)-এর সমসাময়িক। দাউদ (আ.) একাধারে নবী ও বাদশাহ ছিলেন। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। নিজ হাতে যুদ্ধের সরঞ্জাম ও লোহার বর্ম বানাতেন।
লোকমান (আ.) নবী ছিলেন না, তবে নবীর মর্যাদায় আল্লাহর প্রশংসিত জ্ঞানী ছিলেন। তার আলোচনা ও উপদেশমালা পবিত্র কুরআন মাজিদের সূরা লোকমানে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত লোকমান ও দাউদ (আ.)-এর একটি ঘটনা নিয়ে মওলানা রুমি মানবজাতির জন্য একটি বড় উপদেশ পেশ করেছেন। তা হলো- ধৈর্যের মহিমা।
একদিন দাউদ (আ.) যুদ্ধের হাতিয়ার ও লোহার বর্ম তৈরি করছিলেন। আল্লাহতায়ালা শক্ত ইস্পাতকে দাউদ (আ.)-এর জন্য নরম করে দিয়েছিলেন। শক্ত লোহা তার হাতের ছোঁয়ায় গলিত মোমের মতো নরম হয়ে যেত। এসময় লোকমান হাকিম একদিন দাউদ (আ.)-এর সাক্ষাতে যান। তিনি তখন বর্ম তৈরিতে মশগুল। কম বয়সি লোকমান (আ.) চিনতেন না বর্ম কি? তাই সহজ সরল মনে তাকিয়ে দেখছিলেন।
দাউদ (আ.) একটার পর একটা আংটা বানাচ্ছেন। আবার এক আংটার সঙ্গে অন্য আংটা জোড়া দিচ্ছেন। এসময় লোকমান (আ.)-এর মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল- এত বড় বাদশাহ, আল্লাহর নবী- তিন কেন এমন করছেন?
বর্ম কিভাবে তৈরি করতে হয় হযরত লোকমান এর আগে কখনও তা দেখেননি। তিনি ভাবেন, কী হতে পারে এসব লোহার আংটা দিয়ে! যাক, ভালো হয় তার কাছেই জিজ্ঞেস করি, একটার ভেতর আরেকটা আংটা ঢুকিয়ে তিনি এমন করছেন কেন?
কিন্তু না, পরক্ষণে চিন্তা করলেন, জিজ্ঞেস না করে বরং সবর করব। কারণ, ধৈর্য ধারণই সবচেয়ে উত্তম। ধৈর্যই তো মানুষকে সবচেয়ে দ্রুত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দেয়। জিজ্ঞেস না করে বরং চিন্তা করতে থাকি। তাহলেই রহস্য তাড়াতাড়ি উদ্ঘাটিত হবে। ধৈর্যের পাখি সব পাখির চেয়ে অধিক ক্ষিপ্রতায় ওড়ে। সন্ধানীকে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আর যদি জিজ্ঞেস করি, তাড়াহুড়ো করি, তাহলে লক্ষ্য অর্জিত হবে বিলম্বে। সহজ জিনিসটা অধৈর্যের কারণে কঠিন হয়ে যেতে পারে।
নানা চিন্তা করে লোকমান (আ.) ধৈর্য ধরলেন। চুপ রইলেন। দেখতে থাকলেন। এরই মধ্যে দাউদ (আ.) লোকমান (আ.)-এর সামনে বর্মটির নির্মাণ শেষ করলেন। এবার দাউদ (আ.) বর্মটি গায়ে জড়ালেন। হয়ে গেল লোহার জামা বর্ম। এরপর লোকমানকে বুঝিয়ে বললেন, দেখ বাছা! এই জামা পরলে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর ধারালো তরবারির আঘাত গায়ে লাগে না। এটি বিপদ ও শত্রুর মোকাবিলায় বড় শক্ত যুদ্ধাস্ত্র।
এসব কথা শুনে হযরত লোকমান বললেন, ধৈর্যও তো প্রাণ সঞ্জীবক শক্ত কারণ, ধৈর্য সর্বত্র দুঃখ-দুশ্চিন্তা রোধে বর্ম ও দুর্গ। বর্ম শত্রুর বাইরের আঘাত প্রতিহত করে; কিন্তু ধৈর্য ভেতরের শত্রু দুঃখণ্ডদুশ্চিন্তা ও হতাশা দমন করে। ভেতরের ও বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনে সবর।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছো যে, মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অত্যন্ত ভালোবাসেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরছি। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদেক (আ.)।
আল্লাহতায়ালা একদিন হজরত দাউদ (আ.)’র ওপর ওহি নাজিল করলেন। আল্লাহ বললেন, হে দাউদ, ‘খালোদে’ নামের এক মহিলা আছে। আপনি তার কাছে গিয়ে এ সুসংবাদ পৌঁছে দিন যে, সে বেহেশতবাসী হবে এবং বেহেশতে তার স্থান হবে আপনার সঙ্গে।
আল্লাহর আদেশ পেলে দাউদ (আ.) ওই মহিলার বাসায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। শব্দ শুনে তিনি বেরিয়ে এসে বললেন- কী ব্যাপার আপনি এখানে কেন? হযরত দাউদ বললেন, আল্লাহ আমাকে ওহির মাধ্যমে জানিয়েছেন বেহেশতে আপনি আমার সঙ্গী হবেন। খালোদে নামের ওই মহিলা এ খবর শুনে বললেন- আপনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু আল্লাহর কসম-আমার ভেতর এ ধরনের যোগ্যতা নেই। তবে জানালেন যে, তিনি যে কোনো বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করেছেন। দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।
বন্ধুরা, এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানুষের ধৈর্য-শক্তি বৃদ্ধির পেছনে ধর্মীয় জ্ঞান ও ঈমানি শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধৈর্যশক্তি মানুষের জন্য সৎ কাজের সুযোগ ও ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। যারা ধৈর্যশীল হয়, তারা পরকালে পুরস্কারতো পায়ই, একইসঙ্গে ইহকালীন জীবনেও সাফল্য পায় এবং তাদের জীবন হয় প্রশান্তিময়।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ বাংলা ভাষায় প্রচলিত এই বাক্যটি শুনেছো। ইতিহাসের সফল ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনা করলেও এটা স্পষ্ট হয় যে, তাদের বিজয়ের পেছনে ধৈর্য শক্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। যাদের ধৈর্যশক্তি নেই, তারা সামান্য বিপদেও ভেঙে পড়েন। কিন্তু ধৈর্যশীলরা একবার না পারিলে দেখো শতবার’- এই নীতিতে বিশ্বাস করেন। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। অবশেষে তিনি সফল হন। লেখক হেলেন কেলার অন্ধ হওয়ার পরও ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে লেখাপড়া শিখেছেন এবং মানুষের জন্য কাজ করেছেন। এমন অনেকেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন ধৈর্যশীল হওয়ার কারণেই।
তবে ধৈর্য শক্তি ধরে রাখার জন্য কিছু বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত: আমাদের কাজ ও দায়িত্ব এমনভাবে ভাগ করতে হবে- যাতে একই সময়ে একাধিক কাজের চাপ না থাকে। শক্তি ও সামর্থ অনুয়ায়ী সব কিছু করতে হবে।
অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। অন্যের সাফল্য দেখে হতাশ ও ধৈর্যহারা হলে চলবে না।
ধৈর্যশীল হওয়ার জন্য দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনও জরুরি। শান্তি ও স্বস্তি পাওয়ার পদ্ধতিও সঠিকভাবে রপ্ত করতে হবে।
কখনো ধৈর্যহারা হয়ে পড়লে কয়েক বার গভীর নিশ্বাস নিতে হবে। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য সব ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মাথা থেকে সব ধরনের দুঃশ্চিতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। এ সময়টায় টেলিভিশন দেখা বই পড়া কিংবা কোনো কাজ যাবে না। এক অথবা দুই মিনিট পার হওয়ার পর অধৈর্য ভাবটা আরো বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু আরো কিছু সময় শান্ত ও বিশ্রাম অবস্থায় কাটালেই ভেতরের জগতটাকে শান্ত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিটি চিন্তার বিকাশ এবং ধৈর্য শক্তি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর।
ধৈর্য শক্তি বাড়ানোর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো, সব সময় এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। সময় ব্যয় করা ছাড়া কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। ধৈর্যহারা ব্যক্তিরা সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে কাজ সম্পন্ন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। তারা কোনো কাজের জন্যই সময় ব্যয় করতে চান না। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে, অনেক কাজই তাড়াহুড়োর মাধ্যমে করা সম্ভব নয়।
ধৈর্যশক্তি বাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো- অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা। যে কোনো বিষয় আমাদের ভাবনা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী নাও এগোতে পারে। এতে ধৈর্যহীন হয়ে পড়লে কোনো সমাধান আসবে না বরং আরো ক্ষতি হবে। তাই দয়া-মায়া, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত ও পরিস্থিতিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য ধৈর্য ধারণ অত্যন্ত জরুরি।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি বাংলাদেশের এক ছোট্ট বন্ধুকে।

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে বিদায় নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।