মে ০৭, ২০২৩ ১৩:৩১ Asia/Dhaka

'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে চীনের প্রস্তাবিত সিল্করোডের গুরুত্ব এবং চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যকার 'ওয়াখান' করিডোরের ভৌগোলিক অবস্থা ও এর গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজও আমরা 'ওয়াখান' করিডোর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যবর্তী 'ওয়াখান' করিডোর হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যা কিনা পূর্ব এশিয়া ও চীনকে পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। তবে শুধুমাত্র সিল্করোডের অংশ হওয়ার কারণেই যে 'ওয়াখান' করিডোরের গুরুত্ব রয়েছে তা নয়। কেননা উনবিংশ শতাব্দিতে দুই পরাশক্তি অর্থাৎ ব্রিটেন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে আলাদা রাখতে বিশেষ করে সামরিক সংঘাত এড়ানোর ক্ষেত্রে 'ওয়াখান' করিডোর ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল। চীনের বিপ্লবী নেতা মাওসেতুংএর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বাহিনী ১৯৪৯ সালে 'ওয়াখান' করিডোরের একটি অংশ দখল করে নিয়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর 'ওয়াখান'  এলাকায় তারা সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে ওই এলাকাকে সামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

বর্তমানে চীন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনার আওতায় 'ওয়াখান' এলাকাকে সিল্করোডের সাথে যুক্ত করে আফগানিস্তানের এই করিডোরকে আবারো সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছে যাতে চীন ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে পূর্ণতা দেয়া যায়। চীন সরকার 'ওয়াখান' এলাকায় স্থল ও রেলপথ চালু করে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশকে আফগানিস্তান ও ইরানের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ার সাথে যুক্ত করতে চায়। অর্থাৎ ঐতিহাসিক সিল্করোড প্রকল্প বাস্তবায়নের  ফলে ওয়াখানের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব আবারো ফিরে আসবে। আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকার পার্বত্যময় দুর্গম ও সরু ওই এলাকাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। কিন্তু এখন ওয়াখানের গুরুত্বের কারণে আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে গেছে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আফগানিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণতি হয়েছে।

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিরোধ লেগেই আছে কিন্তু তারপরও ওয়াখান এলাকার গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। এ কারণে এই এলাকাকে নিয়ে একদিকে প্রাচ্যের চীন ও রাশিয়া কেন্দ্রিক জোট অন্যদিকে পাশ্চাত্যের আমেরিকা ও ইউরোপ কেন্দ্রিক জোটের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

প্রাচীন সিল্করোড

এর আগের কয়েকটি পর্বের আলোচনায় আমরা মার্কিন প্রস্তাবিত সিল্করোড প্রকল্প মোকাবেলায় চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনার লক্ষ্য ও নানাবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় চীন ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর, ইরান ও চীনের ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি এবং আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডোর প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চীন, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কৌশলগত সহযোগিতা গড়ে উঠবে। আর এ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ওয়াখান এলাকার বিরাট গুরুত্ব রয়েছে।

কিন্তু চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প একবিংশ শতাব্দিতে আমেরিকার সঙ্গে চীনের তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে এবং এই দুই পরাশক্তির মধ্যকার প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। পারস্য উপসাগরীয় এলাকা প্রাকৃতিক জ্বালানিতে ভরপুর এবং হরমুজ প্রণালী দিয়ে ওমান ও আরব সাগর হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তেল ও গ্যাস রপ্তানি করা হয়। এ কারণে চীন ও আমেরিকার কাছে এই এলাকার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তবে এ অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহিশক্তির প্রভাব ও ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীনের মধ্যকার চতুর্পক্ষীয় সহযোগিতার গুরুত্ব বা প্রভাব তুলে ধরা। চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় রয়েছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' যা কিনা চীনের মুসলমান অধ্যুষিত শিন জিয়াং প্রদেশের কাশগড় এলাকা থেকে শুরু হয়েছে এবং তা বিতর্কিত কাশ্মির উপত্যকা পার হয়ে গোয়াদার সমুদ্র বন্দরে গিয়ে শেষ হয়েছে।         

চীন ও পাকিস্তানের এই বিশাল যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্পে প্রাথমিক পর্যায়ে চার হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং এরপর বিনিয়োগের পরিমাণ ছয় হাজার ৫০০ কোটি ডলারে উন্নিত করা হয়েছে।

চীন ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোরে চীন কেন আগ্রহী এবং কেন এতো বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মত রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব চীন তাদের দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। চীনের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চলীয় শিন জিয়াং প্রদেশের উন্নয়ন ঘটানো। কেননা ওই অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে, চীন বহু বছর ধরে শিন জিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাকামী তৎপরতা মোকাবেলা করে আসছে এবং আমেরিকা ও তুরস্ক তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। ফলে বিষয়টি চীনের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বলা হয়ে থাকে বৈষম্য ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অভাবেই চীনের মুসলিম অধ্যুষিত সিন ঝিয়ান এলাকা বিচ্ছন্নতাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ অবস্থায় ওই অঞ্চলে যদি উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগে তাহলে দরিদ্রতা দূর করা এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা ধরে রাখা কঠিন হবে। সে কারণে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর আঞ্চলিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে শুধু চীন কিংবা পাকিস্তান নয় এ অঞ্চলের সীমান্তবর্তী সব দেশই উপকৃত হবে।  

চীনা কর্মকর্তারা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সিপিইসি প্রকল্পে আফগানিস্তানকেও যুক্ত করা গেলে একদিকে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার হবে এবং অন্যদিকে চীন-আফগান সীমান্তবর্তী উইঘুর মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাকামী তৎপরতা ঠেকানো যাবে। চীন মনে করে এভাবে দরিদ্র এলাকায় পুঁজি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ