মে ১৩, ২০২৩ ২২:৪৮ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর এক বছরেরও কম সময় বাকি আছে। সেদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো, দেশের জনগণ সেইসাথে বিদেশিদের নানা বক্তব্য এখন সামনে আসছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি দেশটির সিনিয়র সাংবাদিক এবং বাংলাভিশনের সাবেক হেড অফ নিউজ মোস্তফা ফিরোজের সঙ্গে।

রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বললেন, দলীয় প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখতে বলেছেন এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারো জিতবে। মির্জা ফখরুল ইসলামও বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জিতবে।

তিনি আরো বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা বারবার বিরোধী দলগুলোকে আশ্বস্ত করছেন যে, পরবর্তী নির্বাচন তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। কিন্তু সেখানে অতীতে বিশ্বাসভঙ্গ ও আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হওয়ায় একথা বিরোধী দল বিশ্বাস করছে না। আর বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চাপে আছে বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে কূটনৈতিক দিক থেকে বিরোধী দল বিএনপি এগিয়ে আছে।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি তৈরি, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম।

জনাব মোস্তফা ফিরোজ, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান:  জনাব মোস্তফা ফিরোজ,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটেনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে  বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগ জিতবে এবং তারা সরকার গঠন করবে। দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যখন নানা রকমের সন্দেহ সংশয় কাজ করছে এবং বিরোধী দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে তখন প্রধানমন্ত্রী এই মন্তব্য করলেন। কিভাবে দেখছেন তার এই মন্তব্যকে?

মোস্তফা ফিরোজ: দেখুন, তাঁর এ মন্তব্যের দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সেই দলের প্রধান। ফলে দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি বলবেন-তার দল জিতবে। এটিই স্বাভাবিক। আর এধরনের কথা শুধু আওয়ামী লীগ কেন বিএনপি, জাতীয় পার্টি সবাই বলবে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা জিতব।

এখন প্রসঙ্গ হচ্ছে- বিদ্যমান যে কাঠামোতে এতদিন বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে ২০০৮ সালের পর ২০২১৪ এবং ২০১৮ সালে। সেই কাঠামোতে যদি নির্বাচন হয় তাহলে তো বলার অপেক্ষা রাখেনা তারা ক্ষমতাসীন থাকে তারাই জয়ী হয়। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনের বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতা শুধু এখনকার নয় অতীতের বাস্তবতাও একই কথা বলে যে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কখনও বিরোধী পক্ষ জয়লাভ করেনা। ফলে এই দৃষ্টিকোণ থেকেও হয়তো প্রধানমন্ত্রী একথা বলতে পারেন। তবে বিষয়টি তিনি উহ্য রেখেছেন। কেননা আগামী নির্বাচন নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা আছে যে বর্তমান কাঠামোর বাইরেও হয়তো এবারের নির্বাচন হতে পারে। সেটাও যদি হয় তাহলেও দলের প্রধান হিসেবে তিনি বলতে পারেন যে আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হবে। আর একথা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অসংখ্যবার বলেছেন। যদি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপি বিপুলভাবে জয়ী হবে। আমার ধারণা এটা তার দলের কর্মী-সমর্থকদেরকে উজ্জীবিত রাখার জন্য এই বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

রেডিও তেহরান: জ্বি জনাব মোস্তফা ফিরোজ, প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা বারবার বিরোধী দলগুলোকে আশ্বস্ত করছেন যে, পরবর্তী নির্বাচন তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন প্রধান ভূমিকা পালন করবে। তারপরও বিরোধীদলগুলো প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে আস্থায় নিতে চাইছে না। এর কারণ কি এবং সংকটের সমাধান কোন পথে?

মোস্তফা ফিরোজ: এর মূল কারণ হলো বিশ্বাসভঙ্গের একটি ঘটনা এবং বাস্তবতা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের একটি ঘটনা পরিষ্কারভাবে সামনে এসেছে। তখনও দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিসহ বিরোধী দল নির্বোচনে এসেছিল। তখন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা যাবে না এবং নতুন করে মামলা দেয়া যাবে না। গণভবনের সেই  আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল এ বিষয়ে তারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং তা রাখবে। কিন্তু নির্বাচনি প্রচার অভিযান শুরু হতে না হতেই দেখা গেল এই কাজগুলোই তারা করতে থাকল এবং পুরো পুলিশ প্রশাসন তাদেরকে যেভাবে চাপের মুখে রাখল তাতে বিএনপিসহ বিরোধীদলের প্রচার অভিযান ব্যহত হলো, নির্বাচনি প্রচার প্রচারণা থেকে অনেকেই সরে আসতে বাধ্য হলো এবং প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই কারাগারে যেতে হলো। আর সর্বশেষ যেটি হলো সেটি নির্বাচনে দিনের ভোটটা রাতে হলো। ফলে এরকম একটা অবিশ্বাসের ঘটনা ঘটার পর সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই শুধু না ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারছে না।

তার প্রতিফলন হলো বাম গণতান্ত্রিক জোট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হবে না তারপরও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস কনফারেন্স করে বর্তমান প্রশাসনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। ফলে এই আস্থার সংকটের মুখে একই ব্যবস্থাপনায় তারা আগামী নির্বাচন করবে আর সবাই এটা মেনে নেবে এটি অবিশ্বাস্য! অতীতের ইতিহাসে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ নিজেও দলীয় সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান আছে বলে আমি মনে করছি না এবং দেখছিও না।

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে, জনাব মোস্তফা ফিরোজ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে, রাজপথে জনগণের দাবির ফায়সালা করা হবে। তার এ বক্তব্য বাস্তবতার কতটা কাছাকাছি বলে আপনি মনে করেন?

মোস্তফা ফিরোজ: দেখুন, বিরোধী দল তো সবসময় আন্দোলন সংগ্রাম করবে এটাই স্বাভাবিক। আর সেই আন্দোলন সংগ্রামে চড়াই উৎরাই আছে। কখনও উপরে উঠছে আবার কখনও নিচে নামছে। তবে জনগণ কখন রেসপন্স করবে সেটি বলা যায় না। তবে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ন্যয্য দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে থাকবে এবং জনগণকে আহ্বান জানাবে। আর সেই আহ্বানে কখনও জনগণের নৈতিক সমর্থন থাকবে, কখনও কখনও মনে মনে হয়তো সমর্থন আছে। কিন্তু গতসময়ের যে জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ শঙ্কিত থাকে বলেই হয়তো তারা প্রকাশ্রে রেসপন্স করছে না। তবে এটা এমন না যে সবসময় এই অবস্থাতেই থাকবে। যে কোনো সময় এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে এবং গণআন্দোলন তৈরি হবে। আর এটা কখন কীভাবে হবে সেটা আসলে সময়ই বলে দেবে।

রেডিও তেহরান: জনাব মোস্তফা ফিরোজ আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে চলে এসেছি। সবশেষে জানাতে চাইছি, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই বিশেষ করে শক্তিশালী ও পশ্চিমা দেশগুলোর আনুকূল্য পেতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনার দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে কোন দলের সাফল্য কতটা?

মোস্তফা ফিরোজ: আপনি খেয়াল করবেন এবারেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। তবে সেটি অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের কারণে নয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো যতটা শক্তিশালী ছিল, যতটা চাপ প্রয়োগ করেছিল তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনটা অতটা সক্রিয় ছিল না। ফলে বলা চলে আন্তর্জাতিক চাপ ততোটা ছিল না। তবে এখন প্রেক্ষাপট একেবারেই পাল্টে গেছে। ২০২৮ সালেও বলা যায়  আন্তর্জাতিক চাপ ছিল না। তখন বরঞ্চ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিটা সরকারেরই অনুকূলে ছিল। কিন্তু এখন বিশ্ব বাস্তবতা হলো, আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাপী তাদের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের যে নীতি তার ওপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের যে তাগিদ এবং এই অঞ্চলে চীনের যে আগ্রাসী মনোভাব সবমিলিয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুই দিক থেকেই বাইডেন প্রশাসন অত্যন্ত সক্রিয়। আর সে কারণে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আপাতত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতিকূলে বলেই মনে হচ্ছে।

এসব কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতিটা তৈরি হয়েছে তখন এক অর্থে কূটনৈতিক সমর্থনটা পাচ্ছে খুব জোরালোভাবে বিরোধী দলগুলো। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে সেই ধরনের কিছু দেখা যাচ্ছে না। বরং যারা সমর্থন করছে চীন বা রাশিয়া তাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থিত হচ্ছে না এবং দেশের মানুষও এটা সমর্থন করছে না। কেননা বাংলাদেশের মানুষ সবাই অনুভব করছে এখানে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দরকার এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির যেসব বিষয় লঙ্ঘিত হয়েছে সেই সব পরিস্থিতির যাতে পরিবর্তন ঘটে। আর এসব কারণে পুরো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিটা আমার ধারনা বিএনপির অনুকূলে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি খুব জোরালো হয়ে উঠেছে।#

রেডিও তেহরান: তো জনাব মোস্তফা ফিরোজ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য  আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মোস্তফা ফিরোজ: আপনাকেও ধন্যবাদ এবং আপনার মাধ্যমে শ্রোতা/পাঠকদেরকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/ ১৩

ট্যাগ