মে ১৭, ২০২৩ ১৮:২৭ Asia/Dhaka
  • আরব লীগের বৈঠক
    আরব লীগের বৈঠক

আপনারা হয়তো এরই মধ্যে শুনেছেন আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কায়রোয় অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে ১২ বছর পর এই জোটে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আরব লীগের এই সিদ্ধান্তের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় সংকট শুরু হয়। কয়েকটি আরব দেশ সিরিয়ার সরকার বিরোধী গোষ্ঠী এবং সন্ত্রাসীদেরকে সমর্থন দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিল। সংকট চলাকালে কাতার সিরিয়াকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। এরপর ওই বছরই নভেম্বর মাসে এই জোটে সিরিয়ার সদস্য পদ বাতিল করা হয় এবং দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়। অবশেষে ১২ বছর পর আরব লীগ ফের সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পদক্ষেপ নিলো। এমনকি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ খুব শিগগিরি সৌদি আরব সফরে যাবেন বলে কথা রয়েছে। যাইহোক, সিরিয়াকে কেন বা কিভাবে আরব লীগের ফিরিয়ে আনা হলো তা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। 

সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এরপর আরব দেশগুলোর কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে দামেস্ক সফর করেন। আরব দেশগুলোর সাথে সিরিয়ার স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং আরব লীগে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তারা কথাবার্তা বলেন।

এরপর সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মিকদাদ কয়েকটি আরব দেশ সফর করেন। ১২ বছর পর গত এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি মিশর সফরে যান, এরপর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি সৌদি আরব সফরে যান। এর এক সপ্তাহ পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দামেস্ক সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাথে দেখা করেন। আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মিকদাদ এরপর আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া সফর করেন। ওই সফরের পর তিউনিসিয়ার সাথে সিরিয়ার পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়। এসব সফর থেকে আরব দেশগুলোর সাথে সিরিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়টি ফুটে ওঠে। শেষ পর্যন্ত গত সাত মে কায়রোয় আরব লীগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠকে সিরিয়াকে এই জোটে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতা হয়। 

তবে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি অনেক দূর গড়ালেও কিছু আরব দেশ যেমন কাতার ও মরক্কো এখনো সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেনি। কাতার জানিয়েছে, সিরিয়া আরব লীগে ফিরে এলেও দামেস্কের সাথে তারা এখনই সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

এ অবস্থায় সিরিয়াকে কেন আরব লীগের সদস্য করা হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে প্রথমত, আরব দেশগুলো সিরিয়ার সরকারকে উৎখাতের যে চেষ্টা করেছিল তাতে ব্যর্থতার বিষয়টি তারা মেনে নিয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার সম্মিলিতভাবে গত ১২ বছর ধরে আসাদ সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি বরং সিরিয়া সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আসাদ এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন এবং তাকে উৎখাত করার স্বপ্ন আর কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।

সিরিয়াকে আরব লীগে  ফরিয়ে আনার বিষয়ে বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড লিখেছে, প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাত করার জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বেশিরভাগ এলাকার ওপর আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অন্যদিকে, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি বিরাট অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সরকার বিরোধী এবং মার্কিন সমর্থিত কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হাতে। তবে আসাদ সরকারের পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং আরব দেশগুলো এটা বুঝতে পেরে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবতা উপলব্ধি করেই আরব লীগে সিরিয়ার সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ রয়েছে। গত মার্চ মাসে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়। এই সমঝোতার অর্থ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যকে সংকটের কবল থেকে বের করে আনা। সিরিয়াও ওই প্রচেষ্টারই অংশ। সিরিয়াকে আরব লীগে  ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস লিখেছে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সমঝোতা সিরিয়া সমস্যা সমাধানে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি ইয়েমেন সংকটের মতো মধ্যপ্রাচ্যে আরো অন্যান্য বহু সমস্যা সমাধানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তেহরান-রিয়াদ সম্পর্ক।

আরব লীগে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনার তৃতীয়  কারণ হচ্ছে, সিরিয়া একটি আরব দেশ এবং অভিন্ন জাতিগত বিষয়টি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তাই আরবদের থেকে সিরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা সৌদি আরবসহ কোনো দেশের জন্যই কল্যাণকর নয়। যদিও ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে কৌশলগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রয়েছে কিন্তু তারপরও সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি আরব দেশ তেহরান-দামেস্ক সম্পর্ককে খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না। এ অবস্থায় ধারণা করা হচ্ছে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠা এবং আরব লীগে ওই দেশটিকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আরবরা শত্রুতার পরিবর্তে নিজেদেরকে বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদর আল সাঈফ মনে করেন, সৌদি আরব সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ আরব জোট গঠনের চেষ্টা করছে। 

আরব লীগে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনার চতুর্থ কারণটি আমেরিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সৌদি আরব এটা বুঝতে পেরেছে যে পশ্চিম এশিয়া এখন আর আমেরিকার কাছে অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে আমেরিকার কাছে সৌদি আরবের  কোনো গুরুত্ব তো নেই বরং এ দেশটি স্রেফ আমেরিকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ  কারণে গত বছর  জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরব সফর করলেও রিয়াদ-ওয়াশিংটন সম্পর্ক খুব বেশি দূর এগোয়নি এবং পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সৌদি আরব আরো স্বাধীন নীতি গ্রহণ করেছে। এ কারণে আমেরিকার বিরোধিতা উপেক্ষা করে প্রভাবশালী আরব দেশগুলো সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ  নিয়েছে।

যদিও কাতার, কুয়েত ও মরক্কো এখনো  সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি কিন্তু এ অবস্থারও হয়তো অবসান ঘটবে বলে অনেকে আশাবাদী#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ