মানুষের স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন এক স্ত্রীকে নিয়েই গড়ে ওঠে
সুখের নীড়-৪১ ( বহু-বিবাহ, ইসলাম ও বেহেশতি পরিবার)
প্রশান্ত চিত্ত ও ধৈর্য এমন এক বিষয় যার অভাবে মানুষ অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে। হারানো বিষয় বহু চেষ্টা করেও অনেক সময় আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
বিয়ের ব্যাপারে ভুল নীতিও অনেকটা এমনই এক বিষয়। একাধিক স্ত্রী এমন একটি বিষয় যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। তবে মানুষের স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন এক স্ত্রীকে নিয়েই গড়ে ওঠে। স্বামী-স্ত্রীর সহজ ঐক্য ও আন্তরিকতা বজায় রাখতে এক স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত এবং দাম্পত্য জীবনের পূর্ণতার জন্য তা-ই যথেষ্ট। তাই ইসলাম ধর্ম এক স্ত্রী রাখাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। তবুও কখনও কখনও পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে একটি পরিপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম হিসেবে ইসলাম নানা শর্তসাপেক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে এসব শর্তের উল্লেখ রয়েছে।
অবশ্য ইসলামপূর্ব যুগেও বহু জাতির মধ্যে ও নানা ধর্মীয় বিধানে কয়েকজন স্ত্রীকে নিয়ে পরিবার গড়ে তোলার প্রচলন ছিল। যেমন প্রাচীন ইরাকের প্রথা ছিল এমন যে স্ত্রী যদি অসুস্থ হতেন তাহলে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেয়া হত। অ্যাসিরীয় পুরুষদের মধ্যেও একজন পুরুষের কয়েকজন স্ত্রী থাকত। প্রাচীন ইরান, মিশর, চীন ও ভারতেও এমন প্রথা ছিল। ইসলামপূর্ব যুগের আরব সমাজেও কয়েকজন স্ত্রী থাকত পুরুষদের। তাই মধ্যযুগের ইউরোপিয় প্রাচ্যবিদদের এই দাবী সত্য নয় যে একাধিক স্ত্রীর বিষয়টি কেবল ইসলামেরই বা নবী মুহাম্মাদ (সা)'র প্রবর্তিত প্রথা।
ইসলাম পুরুষদের কয়েকজন স্ত্রী রাখার প্রথা প্রথম চালু করেছে- এ দাবি সত্য নয়। তবে ইসলাম এ প্রথাকে বাতিলও করেনি। ইসলাম সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা বিশেষ জরুরি অবস্থার আলোকে পুরুষদের স্ত্রীর সংখ্যাকে বিপুল মাত্রায় বাড়তে না দিয়ে বরং নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত করেছে। ইসলাম মানুষের ফিতরাত বা প্রকৃতি-বিরোধী কোনো কাজের অনুমতি দেয় না। তাই ইসলামের প্রত্যেক বিধানেরই রয়েছে যুক্তি ও বাস্তবতা। মহানবী (সা) যতদিন মক্কায় ছিলেন ততদিন তাঁর স্ত্রী ছিলেন কেবল একজন। আর তিনি হলেন হযরত খাদিজা (সা.আলাইহা) । হযরত খাদিজার প্রতি মহানবীর বিশ্বস্ততা নৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টান্তের উজ্জ্বলতম সাক্ষ্য। মহানবীর (সা) ২৫ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত কেবল হযরত খাদিজাই ছিলেন সহধর্মীনী । হযরত খাদিজা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন মহানবী অন্য কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি।
কিন্তু মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হওয়ার পর মহানবী (সা) সামাজিক অনিবার্যতার প্রতিফলন ঘটাতে তথা মুসলমান পুরুষদেরকে সহায়হীন বিধবা বা বিশেষ করে ইয়াতিম সন্তান-সন্ততির অধিকারী বিধবা নারীদের বিয়ে করে তাদের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতে উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছেন। এ ধরনের বিয়ের ফলে অসহায় বিধবা নারী একাকীত্বের মানসিক যাতনা ও দারিদ্রের বঞ্চনা থেকেও মুক্তি পান।
অবশ্য পবিত্র কুরআন সাধারণ মানুষের স্বভাবের দিকে লক্ষ্য রেখে এই সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছে যে যদি কেউ মনে করে যে সে তার স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়বিচার বজায় রাখতে পারবে না তাহলে সে যেন কেবল এক স্ত্রীই গ্রহণ করে। (সুরা নিসা:৩) সুরা নিসার ১২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা কখনও নারীদেরকে সমান অধিকার দিয়ে রাখতে পারবে না তথা স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়বিচার বজায় রাখতে পারবে না, যদিও এর আকাঙ্ক্ষী হও। অতএব, কেবল এক স্ত্রীর দিকে সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়ো না, কারণ এতে অন্য স্ত্রীরা দোদুল্যমান হয়ে পড়বে। যদি সংশোধন কর এবং খোদাভীরু হও, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়। সুরা আহজাবের ৫১ নম্বর আয়াতসহ পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াতেই (নিসা ১২৮,১৩০)একাধিক স্ত্রী রাখার শর্ত হিসেবে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করার বিধান এসেছে।
আসলে ইসলাম বিলাসিতার জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান দেয়নি। বরং সামাজিক অনিবার্যতার কারণেই ন্যায়বিচার করার শর্তে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে। অনেক সময় এমনও হয় যে স্ত্রী বন্ধ্যা হওয়ার কারণে পুরুষের জন্য অন্য এক স্ত্রী গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। কখনও যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে সমাজে পুরুষের সংখ্যা কমে গেলে ও নারীর সংখ্যা বেড়ে গেলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়ে। রোগ ও মহামারির ক্ষেত্রেও সাধারণত নারীর চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি। মেয়েদের গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি। ফলে কখনও কখনও সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এ অবস্থায় সব সক্ষম পুরুষ যদি কেবল এক স্ত্রী গ্রহণ করেন তাহলে অনেক নারী বা বিবাহযোগ্য মেয়েই অবিবাহিত থাকবে এবং এর ফলে সামাজিক ও নৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চাকরি ও স্বাধীনতার মত বিয়ে করার অধিকারও নারীর অন্যতম মৌলিক অধিকার। কেউই তাদেরকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। পশ্চিমা বহু সমাজে ব্যভিচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে নারী ও পুরুষের সংখ্যার ভারসাম্যহীনতা এবং পুরুষদের একাধিক বিয়েকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা! একই কারণে এইসব সমাজে পুরুষের সঙ্গে পুরুষের কথিত বিয়ে কিংবা নারীর সঙ্গে নারীর কথিত বিয়ে বা সমকামিতার মত জঘন্য পাপেরও বিস্তার ঘটছে যা থেকে অনেক নারীও মুক্ত নয়। পশ্চিমা সমাজে অনেক পুরুষ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য অনেক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখে। পশ্চিমা পুরুষরা এইসব কথিত নারী বান্ধবীকে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবেই ব্যবহার করে। অথচ একাধিক বিয়ের প্রথাকে স্বীকৃতি দিলে এইসব নারী সসম্মানে স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে সব ধরনের অধিকার ভোগ করতে পারতেন।
ব্রিটিশ গবেষক ও লেখিকা অ্যানি বিসান্ত বলেছেন, পাশ্চাত্য দাবি করে যে তারা পুরুষের বহু বিবাহকে গ্রহণ করেনি, অথচ পশ্চিমা পুরুষরা বাস্তবে অনেক নারীকে স্ত্রীর মতই ব্যবহার করে স্ত্রীর অধিকার দেয়া ছাড়াই। তারা এইসব নারীকে ব্যাপক মাত্রায় ভোগের পর এক সময় পুরোপুরি ত্যাগ করে, ফলে এই নারীরা পরিত্যক্তা নারী হিসেবে পথে পথে ঘুরে বেড়ান! অথচ তারা যদি কোনো পুরুষের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৈধ স্ত্রী হিসেবে মা হতেন তাহলে তারা শত সহস্র গুণ ভালো থাকতেন সম্মান ও অধিকারের দিক থেকে।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী একজন পুরুষ যদি আর্থিক, ন্যায়নীতি, নৈতিকতা ও শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে কয়েকটি পরিবার গঠনের যোগ্যতা রাখেন তাহলে তিনি চাইলে চার স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন।
পবিত্র কুরআনের সুরা রা'দ-এ বেহেশতি পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে: এবং যারা নিজ পালনকর্তার সন্তুষ্টির জন্যে সবর করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে আর আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা মন্দের বিপরীতে ভাল করে, তাদের জন্যে রয়েছে পরকালের গৃহ। তা হচ্ছে বসবাসের বাগান। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানেরা। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।