জুন ১০, ২০২৩ ২১:০৬ Asia/Dhaka

'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর বা সিপিইসি প্রকল্পের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বে ইরান অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি দেশ এবং অন্যদিকে চীন এশিয়ার নয়া পরাশক্তি হিসেবে দ্রুত আত্মপ্রকাশ করছে। মার্কিন গবেষকরা ধারণা করছেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে কিংবা আগামী তিন দশকের মধ্যে চীন অনেক বড় পরাশক্তিতে পরিণত হবে এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে। মার্কিন গবেষকদের এ বক্তব্য এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যা কিনা নয়া সিল্করোড প্রকল্প নামেও পরিচিত। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি ইরানের সম্পর্ক রয়েছে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে ইরান গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার কারণে চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প চীন, পূর্ব এশিয়া, মধ্যএশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ককেশিয় অঞ্চলকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করেছে। আর এই সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকৃতপক্ষে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি এখন এদিকে। ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি কেবল অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, পুজিঁ বিনিয়োগ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং এটি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। পাশ্চাত্যের কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, ইরান-চীন সহযোগিতা চুক্তির পরিধি অনেক বিশাল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পাশ্চাত্যের প্রভাব ও ক্ষমতার জন্য তা বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন বলেছেন, 'ইরান-চীন দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক বড় পরীক্ষা। কেননা ইরান ও চীনের মধ্যকার কৌশলগত সহযোগিতা চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোট গঠনের মার্কিন চেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দেবে।

আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তেহরান-বেইজিং সম্পর্কের ব্যাপারে ইরানের বিশ্লেষক মেহেরদাদ আলী পুর এই দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত চুক্তিকে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ইরানের প্রাচ্য অভিমুখী তৎপরতার নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এটাকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেন। পাশ্চাত্যের বিশ্লেষকরাও ইরানের বিশ্লেষকদের মতো প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। খ্যাতনামা বিশ্লেষক উইলিয়াম ফিগারোয়া বলেছেন, ইরান ও চীনের মধ্যকার সমঝোতা কেবল পুঁজি বিনিয়োগ, বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এ সমঝোতা পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।

আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক ইরান ও চীনের দীর্ঘ ২৫ বছর মেয়াদি সমঝোতাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাদের মতে, আগামী ২৫ বছরে ইরানের তেল ও পেট্রোকেমিকেল খাত, জ্বালানি সরবরাহ লাইন, সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীনের ৪০ হাজার ডলার বিনিয়োগ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে নয়া অধ্যায়ের সূচনা করবে।

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর বা সিপিইসি প্রকল্প এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার সমঝোতা ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় এর ফলে এই দেশগুলোর মধ্যে ধারণাতীত সহযোগিতা গড়ে উঠবে। এমনকি আঞ্চলিক সীমানা পেরিয়ে মধ্যএশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায়ও এর বিরাট প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ইউরোপও নানাভাবে প্রভাবিত হবে।

এবারে আমরা আঞ্চলিক উন্নয়নে ইরানের চবাহার সমুদ্র বন্দর ও পাকিস্তানের গোয়াদার সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব। ইরান ও পাকিস্তানের এ দুটি বন্দরই সীমান্তের খুব কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। এ দুটি বন্দরের সাথে সরাসরি ভারত মহাসাগরের সম্পর্ক রয়েছে এবং এ বন্দরগুলোর মাধ্যমে মধ্যএশিয়ার দেশগুলো সহজে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। তবে এই দুই বন্দরকে কেন্দ্র করে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গড়ে উঠেছে। একদিকে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরে চীন পুঁজি বিনিয়োগ করেছে অন্যদিকে ইরানের চবাহার বন্দরে ভারত পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অর্থ হচ্ছে মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার প্রতিযোগিতা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা। ইরানের ওপর ইরাকের যুদ্ধ চাপিয়ে  দেয়ার আগ মুহূর্তে চবাহার সমুদ্র বন্দর ছিল প্রত্যন্ত এলাকার এবং এর তেমন কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল না।

কিন্তু ইরাকের সেনাবাহিনী ইরানের খোররাম শহর দখল করার পর ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীতে শক্ত প্রতিরোধ  গড়ে তুলে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। তখন থেকে চবাহার বন্দরের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। এমনকি বাইরের দেশগুলোরও নজর কাড়ে। ফলে ভারতসহ আরো অনেক দেশ এই বন্দরে পুঁজি বিনিয়োগ করে। চবাহার ওমান সাগরের পাশে অবস্থিত এবং উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী। মধ্যএশিয়ার সঙ্গে সমুদ্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে এই বন্দর ব্যবহার করে মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর পণ্য সহজে এশিয়ার অন্য দেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মধ্যএশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন ইরানের উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণের চবাহার পর্যন্ত চমতকার সড়ক ও রেলযোগাযোগ রয়েছে। এসব সুবিধা ও অবকাঠামোর কারণে চবাহার মধ্যএশিয়ার পণ্য রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এ  অনন্য বৈশিষ্ট্যের  কারণে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের অনুরোধে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চবাহার বন্দরকে নিষেধাজ্ঞা তালিকার বাইরে রেখেছিল।

২০১৮ সালে রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গে ইরান, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা পত্রে সই হয়েছিল। ওই সমঝোতা অনুযায়ী এই তিন দেশ ব্যবসায়ীক স্বার্থে রাশিয়া থেকে ইরানের দক্ষিণ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ করিডোর চালু করবে এবং এ ক্ষেত্রে চবাহার বন্দরকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ