সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন- পর্ব ৩৯
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা ফাতিরের ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'আর কোন বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন প্রত্যেককেই তার নিজের কাজের জবাবদিহি করতে হবে। এই জবাবদিহিতা এতটাই বিস্তৃত যে, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও এই কৈফিয়তের আওতাভুক্ত থাকবে।
পবিত্র কুরআনের সূরা ইসরার ৩৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না, কান, চোখ, হৃদয়- ওদের প্রত্যেকটির নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।
দায়িত্বশীলতা হচ্ছে মানুষের এমন একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য, যা অর্জন করা যায়। মানুষ চেষ্টা করলেই দায়িত্বশীল হতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যটি ব্যক্তির ইচ্ছা ও সচেতনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গুণটি পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রসহ নানা অঙ্গন থেকে অর্জনের পাশাপাশি ক্রমেই এর বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনও কাজে আসে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই বৈশিষ্ট্য বা গুণের অভাবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা গোটা পৃথিবীই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে তালাকের মতো পারিবারিক নানা অপ্রিয় ঘটনার পেছনেও এই গুণের অনুপস্থিতি দায়ী। বিশেষজ্ঞরা এই বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে মা-বাবাকে বেশি উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সচেতন মা-বাবারাও শিশুকাল থেকেই সন্তানদেরকে দায়িত্বশীলতা শেখানোর চেষ্টা করেন। এ জন্য দায়িত্বশীলতার মনোভাব জোরদারের উপায়গুলো সম্পর্কে আগে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
মানুষ হিসেবে আমাদের ওপর বহুমুখী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হতে পারে। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা, সময়মতো যথাযথ দায়িত্ব পালন করা এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা বা উদাসীনতা প্রদর্শন না করাই দায়িত্বশীলতা বা কর্তব্যপরায়ণতা। আমাদের বাস্তব জীবনে নানা অঙ্গনে যেমন পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাদেরকে। একজন সুনাগরিক এসব দায়িত্ব পালনে সব সময় সচেষ্ট থাকেন। কারণ একজন মানুষকে শুধু নিজের জন্য বা নিজের ভালোর জন্য চিন্তা করলেই চলবে না, শুধু নিজের অগ্রগতি কিংবা উন্নতি নিয়ে চিন্তা না করে বরং নিজের অগ্রগতির পাশাপাশি সমাজের অন্য মানুষদেরকেও এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পুরো সমাজকে এগিয়ে নিতে, উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে চেষ্টা করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সমাজে বসবাস করি। প্রত্যেকই কোনো না কোনো সমাজের সদস্য। একটি সমাজের অংশ হিসেবে সেই সমাজের প্রতি আমাদেরও রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ।
অনেক সময় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা গোটা পৃথিবীর সামগ্রিক কল্যাণের কথা বিবেচনা করে ব্যক্তি স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। যেমন ধরুন, সমাজের হতদরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোকে সুন্দরভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করা সবারই মানবিক দায়িত্ব। দুর্ভাগ্যবশত আমরা সমাজের অসহায় মানুষগুলোর কথা ভুলে যাই, আমরা এটা উপলব্ধি করিনা যেই সমাজ থেকে আমাদের এই অর্থ-বিত্তের অর্জন স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেই সমাজের কাছে অনেক বেশি ঋণী। তাই ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। তাছাড়া সমাজের একটি বড় অংশকে সুবিধাবঞ্চিত রেখে আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ধরনের বৈষম্য থাকলে যতই উন্নয়ন হোক তা টেকসই হবেনা আর এ বৈষম্য নিয়ে স্থিতিশীল সমাজও গঠন করা যাবেনা, কিন্তু সভ্যতার বিকাশের চুড়ায় এসেও মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রচণ্ড অভাব দেখা দিয়েছে। মানুষ ক্রমেই হয়ে উঠছে ব্যক্তি কেন্দ্রিক, ফলে সামাজিক গণ্ডি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্ব নিয়ে কেউ ভাবতে চাইছেন না। মানুষ ক্রমেই তার সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অনেকেই অফিসে বা তার কর্মক্ষেত্রে কাজে ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত। কাজে ফাঁকি দেওয়ার পর অনেকে নিজেকে চালাক ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু প্রচলিত নিয়মানুসারেও কোনো প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে যোগ দেওয়ার অর্থ হলো, ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে মেধা, চিন্তা ও শ্রম ব্যয় করা। চাকরিতে নিয়োগকালে নিয়োগকর্তার মাধ্যমে লিখিত কিংবা মৌখিক চুক্তি হয়। মাসিক বেতনের বিনিময়ে তাদের এ অঙ্গীকার পালন করা হয়। এ অঙ্গীকার পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর অবশ্য কর্তব্য। একইসঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অধীনস্থদের অধিকার নিশ্চিত করা চাকরিদাতার দায়িত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন পবিত্র আমানত। কাজের সময় কাজ না করে গল্প-গুজবে মেতে থাকা, নিজের মতো মোবাইলে কথা বলা, অলসতার আশ্রয় নেওয়া, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, বিলম্বে অফিসে আসা, সময়ের আগেই অফিস থেকে বের হওয়া, মিথ্যা বলা, দুর্নীতি করা, ছাত্রদের কম পড়ানো, প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা এবং সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় গুরুত্ব না দিয়ে নিজের স্বার্থে প্রাইভেট চিকিৎসায় উৎসাহ দেওয়ার মতো ঘটনা সমাজে অহরহই ঘটছে। এগুলো দায়িত্বের প্রতি প্রকাশ্য অবহেলার শামিল।
অর্পিত দায়িত্বে অবহেলাকারীকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ইসলাম ধর্মে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বয়োজ্যেষ্ঠ ও বয়ঃকনিষ্ঠ সবার প্রতি পারস্পরিক দায়িত্ববোধকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ববোধের আলোকে ইসলামের শিক্ষা হলো, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে কোনোরকম অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ড ও দ্বন্দ্ব-কলহ না করা। সমাজের অনাথ, দুস্থ ও হতদরিদ্রদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহায়তা করাও দায়িত্বশীলতার অংশ। দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা ও অমনোযোগিতা নানা ধরনের বিপদ, ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণতা আদর্শ মনুষ্যত্বেরই প্রতীক। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্বে অবহেলা অথবা স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার মতো অনাকাংঙিক্ষত ঘটনাবলী এখন সমাজে সহজেই চোখে পড়ে। এসবের কারণে ছেলেমেয়েরা পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপথগামী ও উদাসীন হতে পারে। বাবা-মায়ের অবহেলার কারণে সন্তানেরা ঠিকমতো পড়াশোনা না করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করলে গোটা সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানবজীবনে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতার প্রভাব সুস্পষ্ট। সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ দায়িত্বশীলতার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি মানুষ যদি নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং প্রত্যেকে নিজের কাজটুকু ঠিকমতো সম্পন্ন করে, তা হলে কোনো কাজই অবহেলিত হয় না। তখন সমাজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে চলতে থাকে এবং দেশ ও জাতি সমৃদ্ধিশালী হয়।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।