কুরআনের আলো
সূরা আল-মুজাদালা: ১২-১৭ (পর্ব-৩)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুজাদালার ১১ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ১২ থেকে ১৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا نَاجَيْتُمُ الرَّسُولَ فَقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيْ نَجْوَاكُمْ صَدَقَةً ذَلِكَ خَيْرٌ لَكُمْ وَأَطْهَرُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (12) أَأَشْفَقْتُمْ أَنْ تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيْ نَجْوَاكُمْ صَدَقَاتٍ فَإِذْ لَمْ تَفْعَلُوا وَتَابَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (13)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন রাসূলের সাথে চুপি চুপি কথা বলতে চাও, তখন তোমাদের এরূপ কথার পূর্বে কিছু সাদাকাহ পেশ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়তর ও পবিত্রতর; কিন্তু যদি তোমরা [সাদাকাহ দিতে] অক্ষম হও, তবে [তা না দিয়েই কথা বলতে পারো] কারণ, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৫৮:১২)
“তোমরা কি চুপি চুপি কথা বলার আগে সাদাকাহ প্রদানে ভয় পেয়ে গেলে? যখন তোমরা তা করতে পারলে না, আর আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন, তখন তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত প্ৰদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।” (৫৮:১৩)
গত আসরে বলা হয়েছিল, উপস্থিত অনেক মানুষের মধ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির গোপন পরামর্শ বা ফিসফিস আলাপকে ইসলাম গর্হিত কাজ মনে করে। এরপর আজকের এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: রাসূলের জামানায় কেউ কেউ ভর মজলিশে তাঁর সঙ্গে গোপনে কথা বলত। মুনাফিকরাই মূলত এ কাজ করত। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যেমন কষ্ট হতো তেমনি উপস্থিত অন্যরা মনোক্ষুণ্ন হতেন। এই বিড়ম্বনার ইতি টানার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন কেউ যদি রাসূলের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চায় তাহলে তাকে আগে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে কিছু টাকা-পয়সা দান করে আসতে হবে। এই কাজের দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। এক- কারো অতি জরুরি প্রয়োজন না হলে যেন রাসূলের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে না যায়। দুই- দরিদ্র মানুষের উপকার করা। পরবতী আয়াতে বোঝা যায়, আল্লাহর এ নির্দেশে কাজ হয়েছিল। এরপর আর কেউ অনর্থক আল্লাহর রাসূলকে গোপন কথার নামে কষ্ট দিত না। তবে হাদিসে এসেছে, একমাত্র যে ব্যক্তি আল্লাহর এই নির্দেশ পালন করেছিলেন তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.)। তিনি যখনই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে রাসূলের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চাইতেন তখনই কিছু দান-খয়রাত করে আসতেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- সমাজ থেকে দারিদ্র নির্মূলের লক্ষ্যে ইসলাম ব্যাপক চেষ্টা করেছে এবং বিভিন্ন অজুহাতে দরিদ্র মানুষের কাছে ধন-সম্পদ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
২- দান-খয়রাত বা সাদাকাহর দু’টি দিক রয়েছে। এর একটি হচ্ছে দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করা এবং অপরটি কৃপণতা ও দুনিয়াপ্রীতির দোষ থেকে সম্পদশালী ব্যক্তিদের মুক্ত করা।
৩- ইসলামের বিধিবিধানগুলো মুমিনের শারীরিক ও আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যার শারীরিক ও আর্থিক সঙ্গতি নেই তার কাছ থেকে জোর করে কোনো কিছু আদায় করা হবে না।
এবারের সূরা মুজাদালাহর ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তরজমা শোনা যাক:
) أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْمًا غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَا مِنْهُمْ وَيَحْلِفُونَ عَلَى الْكَذِبِ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (14) أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (15)
“আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে যে সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহ রাগান্বিত? তারা না তোমাদের লোক, আর না তাদের লোক, আর তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে [বলে যে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।” (৫৮:১৪)
“আল্লাহ্ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। কারণ, তারা যা করত তা কতই না মন্দ।” (৫৮:১৫)
এই দুই আয়াতে মুনাফিকদের একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে আর তা হলো- তারা গোপনে ইসলামের শত্রু ইহুদিদের সঙ্গে যোগসাজশ রাখত। আল্লাহ বলছেন: মুসলমানদেরকে এমন মানুষদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে যারা গোপনে শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে এবং শপথ করে দাবি করে যে, মুসলমানদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার জন্য নয় বরং শত্রুদের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই বন্ধুত্ব। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের লোকদের যেমন মুসলমানরা বিশ্বাস করবে না তেমনি শত্রুরাও তাদেরকে নিজেদের দলভুক্ত ভাবতে পারবে না। ফলে শত্রুরাও তাদের গোপন পরিকল্পনা ও পরামর্শের কথা তাদেরকে জানাত না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- মুসলমানদের ধোকা দিয়ে শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছিল মুনাফিকদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কাজেই এ ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে।
২- অমুসলিমদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, অমুসলিমরা যেন মুসলমানদের ওপর ক্ষমতা বা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
এবারে এই সূরার ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তরজমা শোনা যাক:
اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ فَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ (16) لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (17)
“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে, এবং (এভাবে) তারা মানুষকে আল্লাহর পথ হতে ফিরিয়ে রাখে। সুতরাং তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি।” (৫৮:১৬)
“আল্লাহর [শাস্তি] মোকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তাতি তাদের কোন কাজে আসবে না; তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” ( ৫৮:১৭)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তারা বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে ধর্মভীরু ও মুমিনদের আস্থাভাজন হিসেবে তুলে ধরে। তারা কথা বলার সময় এমনভাবে ধর্ম, আল্লাহ, রাসূল ইত্যাদি কথা বলে যাতে মুমিন ব্যক্তিরা তাদেরকে সহজেই ধার্মিক ও ঈমানদার মনে করে নেয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকদের লক্ষ্য মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া। এ লক্ষ্যে তারা একদিকে ইসলামের পবিত্রতম বিষয়গুলোর শপথ করে এবং অন্যদিকে পার্থিব সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের সমস্ত মেধা, শ্রম, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততিকে কাজে লাগায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলছেন, কিয়ামতের দিন এগুলোর কোনোটিই তাদের কাজে আসবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- ধর্মের ক্ষতি করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা মুনাফিকদের কাজ। তারা তাদের কথা ও আচরণে নিজেদেরকে ধার্মিক হিসেবে তুলে ধরলেও আসলে তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
২- মুনাফিকরা নিজেদেরকে অনেক চতুর মনে করে। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, কপটতার শাস্তি তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে পেতে হবে।
৩- সম্পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে পার্থিব জগতে অনেক কার্যসিদ্ধি সম্ভব হলেও আখিরাতে এসব কোনো কাজে আসবে না।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।