সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ৪৭
আপনি সত্যিই হয়তো কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন: আপনাকে কেউ কথার মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করল, এরপর আপনার ভেতরটা চাইছে এর একটা উপযুক্ত জবাব দিতে। কিন্তু আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। এর ফলে আপনি অপমান সহ্য করে নিলেন।
আবার এমনও হতে পারে অপমানজনক ঐ আচরণে আপনি মারাত্মকভাবে রেগে গিয়ে অপমানকারী ব্যক্তির সঙ্গে খুবই উগ্র আচরণ করে বসেছেন। এ ধরণের ঘটনায় ব্যাপক বাগবিতণ্ডাও শুরু হয়ে যায়। একেবারে নিশ্চুপ বা নিষ্ক্রিয় থাকা এবং আক্রমণাত্মক আচরণ করার মধ্যে সীমারেখাটা অত্যন্ত সরু। আমাদের সবার উচিৎ এই দুইয়ের মাঝামাঝি পন্থা অনুসরণ করা। এই দুই পন্থার মাঝামাঝি পথ অনেকেরই জানা থাকে না। এই পথ বা দক্ষতাকে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার কৌশল বলা হয়ে থাকে। আত্মসম্মানের মনস্তত্ত্ব বইয়ের লেখক নাথানেইল ব্রানডেন বলেছেন, আত্মসম্মানের ক্ষেত্রে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার অর্থ হচ্ছে আমি নিজে আমার চাহিদা ও মূল্যবোধের প্রতি সম্মান বজায় রাখব এবং আমি এমন পদ্ধতি অনুসরণ করব যাতে সেগুলো সঠিক উপায়ে তুলে ধরতে পারি। নিজের চাহিদা ও আবেদনের প্রকাশ যেন আক্রমণাত্মক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তাও গ্রহণযোগ্য নয়।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ধরুন, আপনি একটা রেস্টুরেন্টে গেছেন খাবার খেতে। সেখানে আপনি খাবারের অর্ডার দিয়েছেন, কিন্তু রেস্টুরেন্টের লোকজন আপনাকে বাড়তি পানীয় কেনার জন্য অনুরোধ করছে। আপনি নেবেন না বলার পরও তারা আপনাকে জোর করে তা গছিয়ে দিয়েছে এবং বিলও করে ফেলেছে। আপনি যদি এর জবাবে কিছু না বলেন তাহলে আপনি নিষ্ক্রিয় থাকলেন। কিন্তু আপনি যদি ধমকা-ধমকি শুরু করে দেন এবং টেবিল চাপড়াতে শুরু করেন তাহলে বলতে হবে আপনি আক্রমণাত্মক আচরণ করেছেন। তাহলে এ ক্ষেত্রে সমাধান কি? সমাধান হলো ভদ্র আচরণের মাধ্যমে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের বক্তব্য তুলে ধরা। আপনি কোষাধ্যক্ষকে গিয়ে বিলটি দেখিয়ে ভদ্রভাবে বলুন- আপনি বাড়তি পানীয় চাননি, কিন্তু এরপরও দেওয়া হয়েছে এবং বিলেও তা এসেছে। কাজেই আগের বিলটি সংশোধন করে নতুন বিল করতে হবে। আপনার বক্তব্য শুনে অবশ্যই অ্যাকাউটেন্ট তা সংশোধন করে দেবেন।
নিষ্ক্রিয় আচরণ, উগ্র আচরণ এবং দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের অধিকার আদায়-এসব বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। দৃঢ়তার সঙ্গে নিজের সঠিক অবস্থান তুলে ধরা সবার জন্যই জরুরি। সমাজে চলতে গেলে আরও একটি বিষয় খুব জরুরি, আর তাহলো 'না' বলার সাহস। আমরা সহজেই 'না' বলতে পারি না। এ কারণে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। জীবনটা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। অনেকেই ভাবেন ‘না’ বলার অর্থ হেরে যাওয়া বা পরাজয় স্বীকার করা। কিন্তু বিষয়টি আসলে মোটেও সেই রকম নয়। আপনার পক্ষে যে কাজটি করা সম্ভব নয় অথবা করা ঠিক হবে না সেটাকে 'না' বলে দিন। কিন্তু যদি আপনি ‘না' কথাটি বলতে না পারেন তাহলে আপনাকে অনেক বেশি চাপ নিতে হবে। আপনার কাজের পরিমাণ হয়ে দাঁড়াবে আপনার ক্ষমতার চেয়েও বেশি। আমাদের সমাজ ‘না’ শুনতে অভ্যস্ত নয়। তাই হুট করেই এই অভ্যাস শুরু করলে অনেক ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই ‘না’ বলতে হবে এমনভাবে যেন তা অবশ্যই গৃহীত হয়। তাই ‘না’ বলাটিকে করে তুলুন শিল্প। কাউকে আঘাত না করেই 'না' কথাটি বলতে শিখে নিন।
মনে করুন আপনার দুইজন বন্ধু আছে, দুইজনই তার সাথে রাত ৮টায় দেখা করতে বলল। একজন যেতে বলল হাসপাতালে, আরেকজন বলল জন্মদিনে পার্টিতে। আপনি কি দুই জনের সাথে একসাথে দেখা করতে পারবেন? কোনটা বেশি জরুরি – তা বুঝে নিয়ে আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আপনি কোথায় যাবেন। আপনি যদি ভালোমতো বুঝতে পারেন যে আপনার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তাহলে না বলাটা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু কিভাবে না বলবেন? বিকল্প সমাধান অফার করাটা ‘না’ বলার একটি দারুণ উপায় হতে পারে। এতে করে ‘না’ বলার পাশাপাশি, সামনের মানুষটিকেও কষ্ট দেয়া হবে না। এতে করে আপনার ওপর চাপ কমবে। আপনার কাছে যদি কেউ কোনও সাহায্য চায়, যা এই মূহুর্তে করতে গেলে আপনার নিজের কাজ নষ্ট হবে, তাহলে একটি বিকল্প বুদ্ধি দিলে তারও উপকার হবে, সাথে আপনারও উপকার হবে। যখন আপনি কার্যকর কোনও বিকল্প সমাধান দেবেন, তখন আপনি নিজের কাজ ঠিক রেখেও মানুষটিকে সাহায্য করলেন। আপনি ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়াই সমস্যার সমাধানে অবদান রাখছেন, যা অন্য মানুষটিকেও খুশি করবে। এরফলে আপনার মাঝে কোনও ধরনের অপরাধবোধ জাগবে না।
নিজের সম্পর্কে নিজের সঠিক মূল্যায়ন জরুরি। আপনি যদি আপনার মূল্য বুঝতে পারেন তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনেকেই নিজেকে অন্যের চোখ দিয়ে মাপে। অন্যের কাছে ভালো মানে নিজে ভালো, অন্যের চোখে খারাপ মানেই নিজে খারাপ। এই ধরনের মনোভাব আসলে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। অনেকেই চান না অন্যরা তার ওপরে বিরক্ত হোক বা অপছন্দ করুক, বা তার ওপরে কোনও কারণে হতাশ হোক। কিছু মানুষের জীবনের একমাত্র চাওয়াই অন্যদের কাছে পছন্দের পাত্র হওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন মানুষের পক্ষে এটা অসম্ভব। কাজেই এ ক্ষেত্রে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। নিজের সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। আপনার যদি আগে থেকেই জানা থাকে যে, আপনাকে কেউ এমন কিছু করতে বলতে পারে, যা করা আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে – তবে কি উত্তর দেবেন, তা আগেই ঠিক করে রাখুন।
হঠাৎ করে কিছু বলতে গেলে অনেক সময়ে আমরা ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারি না। আর সেই অবস্থায় কাউকে ‘না’ কথাটি বলতে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়। তাই আপনারও যদি এমন কোনও সমস্যা থাকে, তবে আপনার উচিৎ কথাগুলো আগে থেকে গুছিয়ে রাখা। এতেকরে না করাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রয়োজনে আয়নার সামনে প্রাকটিস করুন, যাতে কথাটা শোনা মাত্র জবাব দিতে পারেন। তবে, এটা যে আপনি প্রাকটিস করেছেন, সেটা যেন সামনের মানুষটি বুঝতে না পারে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।