জুলাই ২০, ২০২৩ ২০:৪৭ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি এরকম: 'ভরপেট খোর রাখে না ক্ষুধার খবর। পথিকের কষ্ট বোঝে না উট-সওয়ার'। এই প্রবাদের পেছনে রয়েছে চমৎকার একটি গল্প। গল্পটি হলো:

এক লোক তার উটের পিঠে আরোহন করলো। উট নিয়ে সে যাচ্ছিলো মরু প্রান্তরের পানিশূন্য, শুকনো এবং ঘাসবিহীন বালুকাময় পথ ধরে। যাচ্ছিলো তো যাচ্ছিলো, বুঝতেই পারছিল না যে সে পথ হারিয়ে বসে আছে। মনে মনে চাচ্ছিলো যত দ্রুত সম্ভব সে তার গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছতে এবং পথের ক্লান্তি ভুলে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস নিতে।

উটের পিঠের সওয়ারি যেতে যেতে পথেই এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। লোকটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। লোকটির কাঁধে শোভা পাচ্ছিলো হাতে বোণা চমৎকার একটি খোরজিন। কাঁধের দুই দিকে পিঠে এবং বুকের ওপর বড়ো সড়ো পকেটের মতো দেখতে তুলা কিংবা উলের সূতা দিয়ে বানানো একটি ব্যাগ হলো খোরজিন। দূরের কোনো পথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এই খোরজিনে নিয়ে সফরে বের হয় মুসাফির কিংবা ব্যবসায়ীরা। এই মুসাফির উট-আরোহীর বিপরীতে বুঝতে পারছিল যে সে তার পথ হারিয়েছে। তো উটের পিঠে চড়ে চলা লোকটি একটা সময় পায়ে হেঁটে চলা মুসাফিরের কাছে পৌঁছলো। তাকে দেখে উট আরোহী একটু থামলো এবং সালাম করলো মুসাফিরকে।

সালামের জবাব দিয়ে মুসাফিরও উট-সওয়ারির দিকে তাকালো। ক্লান্ত শ্রান্ত মুসাফির বিনয়ের সঙ্গে বললো: হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি! পা আর চলতে চাইছে না। আমার কাছে টাকা-পয়সাও নেই। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?

উট সওয়ারি বললো: কী সাহায্য?

হেঁটে চলা পথিক বললো: আমাকেও তোমার সঙ্গে তোমার উটে চড়ে যেতে দাও! পা একদম চলছে না ভাই!

কথাটা শুনে উট-আরোহীর মন খানিকটা গলে গেল। সে মনে মনে পথিককেও সওয়ার করার কথা ভাবলো। কিন্তু একটু পরেই আবার মনে মনে ভাবলো: ক্লান্ত হয়েছে তো আমার কী! আমার উটও তো ক্লান্ত। ও যদি এখন আমার উটের পিঠে চড়ে তাহলে বেচারা উটও তো আর পথ চলতে পারবে না। আমার পথচলার গতিও কমে যাবে এবং গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কে জানে হয়তো সূর্য ডোবার আগে গন্তব্যে নাও পৌঁছতে পারি। তখন তো আরও বিপদ হয়ে যাবে।

 এইসব ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত উট-আরোহী পায়ে হেঁটে চলা পথিকের দিকে ফিরে বললো: তোমার ওই সুন্দর খোরজিনটা বিক্রি করে দাও! বিনিময়ে যা টাকা পাও তা দিয়ে একটা গাধা কিনে নাও। ওই গাধায় চড়ে তোমার গন্তব্যে যেতে পারবে, আর পায়ে হেটে যেতে হবে না। পায়ে চলা পথিক বিরক্তির হাসি হেসে বললো: এই নির্জন মরুভূমিতে এসব কথা বলে কী লাভ। আর খোরজিনটা আমার সফরের জন্য প্রয়োজনও। খোরজিনে কিছু খাবার দাবার নিয়েছি ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাবার জন্য। সামান্য রুটি আছে, একটু পানি আর খোরমাও আছে এতে। অনেক দূরের পথ। ক্ষুধা লেগে গেলে কী খাবো। এগুলো আমার কাজে লাগবে। তাছাড়া এখানে কে আমার এই খোরজিন কিনতে আসবে আর আমিই বা কার কাছ থেকে গাধা কিনতে পারবো।

দুই পথিকের মাঝে তাদের নিজ নিজ সামান মানে একজনের খোরজিন আর অপরজনের উটের সমস্যা নিয়ে কথোপকথন হচ্ছিলো। উট-সওয়ার পায়ে চলা পথিকের কথা শুনে বললো: আমারও তো আমার উটের প্রয়োজন আছে। তোমাকে যদি আমার উটের পিঠে চড়তে দেই তাহলে আমি অনেক দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছবো। সুতরাং দু:খিত-এই বলে উট-সওয়ার পায়ে হেটে চলা পথিককে রেখে চলে গেল। কিছুদূর যাবার পর সে বুঝতে পারলো-পথ হারিয়ে বসেছে। উটকে তাড়া দিতে লাগলো যাতে আরও দ্রুত যায়। উট দ্রুতই চলতে লাগলো। কিন্তু যতই উট সামনে দ্রুত চললো পথের কোনো নাগালিই পেল না। পথ যেন শেষই হচ্ছে না …।

এদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতে লাগলো। উট-সওয়ার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লো। উটের পিঠ থেকে নামলো। বুঝতে পারছিলো না কী করবে। এদিক-ওদিক তাকালো। মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। একটু পরে বেশ দূরে ধূসর রঙের কী যেন দেখতে পেলো। ভাবছিলো এগিয়ে গিয়ে পথ জিজ্ঞেস করবে কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় পারলো না যেতে। ধূসর রঙটিই যেন কাছে আসছিল। পুরোপুরি কাছে আসার পর দেখলো-সেই লোক যাকে সে উটের পিঠে উঠতে দেয় নি। সালাম দিয়ে বললো: আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত! পথও হারিয়েছি। আমাকে কি একটু রুটি আর পানি দেবে!

পথিক রহস্যের হাসি দিয়ে বললো: তোমার উটটা বিক্রি করো! বিক্রির টাকায় রুটি,পানি, খোরমা কিনে খাও।

উট-সওয়ার বুঝলো পথিক তার কথাই তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

উট-সওয়ার সামান্য পানি চাইলো। পথিক বললো: আমার খোরজিনটা ছোট। একজনের খাবার-পানির পরিমাণ জায়গা আছে। ঠিক তোমার উটের মতো-একজনের বেশি মানুষের জায়গা হয় না। এই বলে পথিক চলে গেল। উট-সওয়ার সেখানেই বসে পড়লো। পথিকও কোথায় যাবে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। সেও কিছু পথ গিয়ে বসে পড়লো। উটও একটু লতাগুল্মের সন্ধানে গেল। এভাবেই রাত কেটে সকাল হলো। পথিকের পা ফুলে গেল। রুটি-পানিও শেষ। উট-সওয়ারিও ক্ষুধায় মরতে বসেছে। উটও নেই। দুদিন পর পাশের এক গ্রামে গিয়ে উঠলো সওয়ারিবিহীন উট। এক লোক দেখতে পেল। কী কাণ্ড! জিনও আছে, লাগামও আছে, সওয়ারি নেই। গ্রামের লোকজন ঘোড়া নিয়ে সওয়ারির সন্ধানে বের হলো এবং মরুভূমিতে একজনের পরিবর্তে দুইজনকে তারা খুঁজে পেলো।

একজন ক্লান্তির ভারে বেহুশ আরেকজন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। এই ঘটনার পর থেকে মানুষকে বলতে শোনা যায়: ভরপেট খোর রাখে না ক্ষুধার খবর। পথিকের কষ্ট বোঝে না উট-সওয়ার।#

পার্সটুডে/এনএম/২০/৬৮

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ