আগস্ট ১৩, ২০২৩ ১৬:২৬ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে আবারো হাজির হয়েছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আক্তার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ধৈর্য একটি মহৎ গুণ। ধৈর্যকে সাফল্যের চাবিকাঠিও বলা হয়। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূল এবং আহলে বাইতের মহান ইমামগণ এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ধৈর্য বা সবরের অর্থ হচ্ছে- দুঃখ-কষ্ট দেখে মন খারাপ কিংবা রাগ না করা।

মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে বলেন, "অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ।" (৪৬:৩৫)।

রাব্বুল আলামিন আরো বলেছেন, "তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।" (২:৪৫, ১৫৩)।

শত্রু ও বিরোধীদের মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো ধৈর্য। মহান আল্লাহ বলেন, "তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকি হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না।" (৩:১২০)।

অন্যদিকে রাসূল (সা.) বলেছেন, "রাগান্বিত হয়ো না। আর যদি রাগান্বিত হও, তা হলে বসে পড় এবং আল্লাহর বান্দাদের ওপর তাঁর ক্ষমতার কথা এবং তাদের প্রতি তাঁর ধৈর্যের কথা চিন্তা কর। আর যখন তোমাকে বলা হয় : আল্লাহকে ভয় করো, তখন তোমার ক্রোধকে দূরে ঠেলে দাও এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় প্রত্যাবর্তন কর।"

তিনি আরো বলেছেন, পুণ্যের দরজা তিনটি: মনের উদারতা, মিষ্ট ভাষা, আর কষ্ট ও উৎপাতে ধৈর্যধারণ করা।

বন্ধুরা, ধৈর্য সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানা হলো। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব। এছাড়া থাকবে ধৈর্য বা সরব সম্পর্কে দুটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন সহকর্মী আশরাফুর রহমান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)'র ত্যাগ ও ধৈর্য ছিল নজীরবিহীন। আর এটাই ছিল ইসলাম প্রচারে তাঁর সাফল্যের অন্যতম রহস্য। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে চারদিক থেকে শত্রুদের অসহনীয় চাপ, জুলুম-নির্যাতন ও কটুকথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু রহমত ও দয়ার নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সত্য প্রচারের ময়দানে সবসময় ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ও ধৈর্যশীল। আজকের অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমরা নবীজীবনের একটি গল্প বলব যেখানে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। মদীনায় যায়েদ নামে এক ইহুদি তাঁর নিজের একটা ঘটনা নবীজীকে এভাবে বলল-

'একদিন একাকী ঘরে বসে ছিলাম। তাওরাত পড়ছিলাম। তাওরাতের এক জায়গায় সর্বশেষ পয়গাম্বরের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়লাম। একটা বৈশিষ্ট্য হলো- নম্রতা ও সহিষ্ণুতা। নিজে নিজে ভাবলাম- মন্দ নয়, মুহাম্মাদের এই বৈশিষ্ট্যটা পরীক্ষা করে দেখব এবং কিছুক্ষণ তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণ লক্ষ্য করব। তাওরাতে পড়েছিলাম যে, রাগের ওপরে তাঁর ধৈর্য বিজয়ী। এই বিষয়টা দেখার জন্যে আমি মদীনার মসজিদের দিকে রওনা হলাম। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময়েই মরুবাসী আরবদের দেখলাম মুহাম্মাদের কাছে এসে তাদের নওমুসলিম গোত্রের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে বলছে। তারা মুহাম্মাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতারও আবেদন জানায়। মুহাম্মাদ তাদের কথা শোনার পর হযরত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এমন কোনো মালামাল কি আছে এদেরকে দেয়ার মতো?' আলী (আ.) বললেন, 'আপাতত কিছুই নাই।'

ঠিক সে সময় আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বললাম, এই টাকাটা আমি ঋণ হিসেবে আপনাকে দিচ্ছি। তবে এই টাকার বিনিময়ে আমাকে খুরমার একটা অংশ দিতে হবে। মুহাম্মাদ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং আমার কাছ থেকে একটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিলেন। সেই টাকা দিয়ে মরুবাসী ওই আরবদের প্রয়োজন মেটালেন।

যায়েদ আরো বলল: খুরমা তোলার আর অল্প ক'দিন বাকি ছিল। কিন্তু আমি মুহাম্মাদের ধৈর্য পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁর কাছে গেলাম। আমি জানতাম যে, আমার ঋণ পরিশোধ করবার এখনো কিছুদিন বাকি আছে। তারপরও ঝগড়াটে মনোবৃত্তি নিয়ে বললাম, 'হে মুহাম্মাদ! জনগণের সম্পদ দেয়ার ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা করছেন কেন?'

আমি একদম বেপরোয়াভাবে অসৌজন্যমূলক ভাষায় কথা বললাম, অথচ উনি এতো শান্ত এবং মার্জিত ছিলেন যে, এরকম ধৈর্য আমি আর কারো মাঝে দেখি নি। মুহাম্মাদ খালি শুনলেনই আর আমি কেবল অসৌজন্যমূলক আচরণই করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মুহাম্মাদের সঙ্গীদের একজন রেগেমেগে আমার কাছে আমাকে গালি দিল। মুহাম্মাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- 'শান্ত হও! উত্তেজিত হবার প্রয়োজন নেই। বরং যায়েদকে ধৈর্য ধারণ করতে বলা উচিত।'

অবশেষে যখন খুরমা পাকল এবং আমার ঋণ পরিশোধ করার সময় হলো, তখন তিনি আদেশ দিলেন আমার প্রাপ্য খুরমাকে অন্যভাবে প্রস্তুত করতে। যখন খুরমাগুলো গ্রহণ করলাম বুঝতে পারলাম যে, আমার প্রাপ্য যতোটুকু তারচে বেশি খুরমা আমাকে দেয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই অতিরিক্ত খুরমাগুলো কীজন্য? বললেন- 'যেহেতু তুমি নবীজীর এক সঙ্গীর উত্তেজিত কণ্ঠের কারণে কষ্ট পেয়েছো, সেজন্যে রাসূলে খোদা আদেশ দিয়েছেন তোমার সন্তুষ্টির জন্যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে অতিরিক্ত কিছু খেজুর তোমাকে দিয়ে দিতে।'

যায়েদ বলল: আমি মুহাম্মাদের নজীরবিহীন চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হলাম এবং আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদের রেসালাতের সাক্ষ্য দিলাম। অবশেষে মুসলমানদের কাতারে নিজেও অন্তর্ভুক্ত হলাম।

বন্ধুরা, নবীজির ধৈর্য সম্পর্কে সত্য ঘটনাটি শুনলে। আমরাও যেন ধৈর্যশীল হতে পারি মহান আল্লাহর কাছে আমাদের এটাই প্রার্থনা।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, বিশ্বনবীর বংশধর তথা আহলে বাইতের ইমামগণও ধৈর্যের মুর্তপ্রতীক ছিলেন। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমরা নবীজির প্রাণপ্রিয় নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ধৈর্য সম্পর্কে একটি ঘটনা শোনাব:

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি হজ অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য মদীনায় আসল। মসজিদে নববীতে একদিন হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়ল এমন এক ব্যক্তির ওপর যিনি মসজিদের এক কোণে বসেছিলেন। সে ভাবতে লাগল যে, এ লোকটি কে? কাছেই দাঁড়ানো অপর এক লোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ লোকটি কে ভাই’? সে বলল, তিনি হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আ.)’।

পবিত্র এ নামটি শোনার সাথে সাথেই ক্রোধ ও ক্ষোভে লোকটির চেহারা লাল হয়ে গেল। অশ্রাব্য, বিশ্রী ও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে সে ইমামকে গালি দিয়ে তার অন্তরের জ্বালা মিটাল এবং তার মনের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করল। কারণ আগে থেকেই ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা তার মন-মগজকে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে  বিগড়ে রেখেছিল।

ইমাম হুসাইন (আ.) তার গালাগালিতে মোটেও রাগ করলেন না, বরং অত্যন্ত ভালোবেসে ও সদ্ব্যবহারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আল-কুরআনের সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন, যে আয়াতগুলোতে ভালো ব্যবহার, ক্ষমা প্রদর্শন ও মার্জনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কুরআনের আয়াতগুলো পাঠ করার পর ইমাম হুসাইন (আ.) সিরিয়ার অধিবাসী সে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,‘ আমি তোমার যে কোনো খেদমত ও সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি’। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘ তুমি কি সিরিয়ার অধিবাসী’? জবাবে সে বলল,‘ হ্যাঁ! আমি একজন সিরিয়ার অধিবাসী’। তখন ইমাম তাকে বললেন, ‘সিরিয়াবাসীদের এরূপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আর আমি খুব ভালোভাবে জানি, এ দুর্ব্যবহার ও শত্রুতার কারণ কী?

অতঃপর ইমাম লোকটিকে বললেন, ‘তুমি এ শহরে একজন মুসাফির। বিদেশের বাড়িতে যদি তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। আমি তোমার যে কোন খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আমার মেহমান করতে চাই এবং তোমাকে পোশাক-পরিচ্ছদ ও টাকা-পয়সা ইত্যাদিও দিতে চাই’।

সিরিয়াবাসী লোকটি তার দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজের জন্য একটা কঠোর পরিণতির অপেক্ষা করছিল। সে কখনোই এ আশা করেনি যে, তার এ অপরাধ ও ধৃষ্টতা একেবারেই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে। ইমামের এ সুন্দর ব্যবহার তার মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলব। সে নিজে নিজে বলতে লাগল, ‘আমার মন চায় যে, মাটি ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। হায় আফসোস! নিজের অজ্ঞতার কারণে আমি যদি এ অপরাধ না করতাম! এর আগ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পিতার চেয়ে বড় দুশমন আর কেউ ছিল না। আর এখন আমার দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পিতার চাইতে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই’।

বন্ধুরা, এবার আমরা ইমাম হুসাইনের নাতি ইমাম বাকের (আ.) ও এক খ্রিস্টানের সত্য ঘটনা তুলে ধরব। ইমাম বাকের (আ.) এর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনুল হুসাইন (আ.)। ‘বাকের’ ছিল তার উপাধি। 'বাকের' শব্দের আভিধানিক অর্থ 'ভাগ-বিশেষণকারী'। তাকে বলা হতো ‘বাকেরুল উলুম’ যার অর্থ হচ্ছে 'জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাগ-বিশেষণ ও ব্যাখ্যাকারী।'

একবার এক খ্রিস্টান ‘বাকের’ শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ইমামের সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে চাইল। সে ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বলল,‘ আনতা বাক্বার অর্থাৎ তুমি গাভী’।

এমন কটু কথা শুনেও ইমাম অসন্তুষ্ট বা রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্ত সরল ও সহজ ভাষায় বললেন, ‘না ভাই! আমি বাক্বার নই। আমি বাকের’।

এরপর খ্রিস্টান লোকটি বলল, ‘তুমি একটা রাঁধুনির ছেলে। ইমাম বললেন, 'এটা তার পেশা ছিল। এতে কোনো লজ্জা বা ঘৃণার কিছু নেই।'

খ্রিস্টান লোকটি আরো বলল, ‘তোমার মা ছিল কালো কুৎসিত। তার লজ্জা-শরম কিছুই ছিল না। আর তার ভাষাও ছিল বিশ্রী’।

এবারও ইমাম অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় বললেন, ‘আমার মাতা সম্পর্কে তুমি যেসব অপবাদ দিচ্ছো তা যদি সত্য হয় তাহলে মহান আল্লাহ যেন তার গুণাহ খাতা মাফ করে দেন। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে যেন তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। কেননা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া বড়ই গুণাহের কাজ।

ইমাম বাকের (আ.)-এর এসব কথা খ্রিস্টান লোকটির মনের ভেতরে বিপ্লব সৃষ্টি করল। সে অনুশোচনা দগ্ধ হতে লাগল এবং পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে গেল।

ধৈর্যের পুরস্কার সম্পর্কে একে তিনটি ঘটনা শুনলে। অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে রয়েছে ধৈর্য বা সবর সম্পর্কে আরেকটি গান। গানের কথা লিখেছেন তারান্নুম তাসনিম সামারা, সুর করেছেন যায়িদ রুসাফি আর গেয়েছে শিশুশিল্পী জাইমা নূর।

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ