আগস্ট ২৮, ২০২৩ ১৯:৪৬ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। সপ্তাহ ঘুরে রংধনুর আসর সাজিয়ে তোমাদের মাঝে হাজির হয়েছি যথারীতি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি রেজওয়ান হোসেন।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর খ্যাতনামা দরবেশ ও আল্লাহর অলী হযরত ইব্রাহিম বিন আদহামের নাম শুনেছো। তার প্রকৃত নাম- আবু ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে আদহাম ইবনে সুলাইমান ইবনে মনসূর বলখী। তার জন্ম হয়েছিল ১০০ হিজরীতে আর ইন্তেকাল ১৬১ হিজরীতে। যৌবনকালে তিনি ছিলেন পূর্ব খোরাসানের ‘বলখ’ রাজ্যের শাসনকর্তা বর্তমানে যা আফগানিস্তানে অবস্থিত। তখন তার শান-শওকত ও মর্যাদার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ জগতের সকল কিছু ছেড়ে দরবেশের পথ ধরেন। বিখ্যাত এ মনীষী পরবর্তীতে আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বিচারবুদ্ধি ও যুক্তি ও চিন্তাধারা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তবে, তার এই পরিবর্তনের সঠিক ও সুস্পষ্ট কারণ আজ অবধি কেউ অবগত হতে পারেনি। অবশ্য স্বনামধন্য ইরানি সাধক ও অলী-দরবেশ শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাবুরী’ তাঁর ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ -কিতাবে ইব্রাহিম আদহামের ব্যাপারে দু’টি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যার দু’টিই পৃথকভাবে আল্লাহর এই অলীর মানসিক ও রুহানী অবস্থার পরিবর্তনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এছাড়া, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি তার বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবি শরীফে ইব্রাহিম বলখির কাহিনী ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছেন।

বন্ধুরা, আজকের আসরে আমরা ইব্রাহিম আদহামকে নিয়ে প্রচলিত কয়েকটি সত্য ঘটনা শোনাব। তার পর থেকে একটি কবিতা ও একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই সত্য ঘটনাগুলো শোনা যাক।

বাদশাহ ইব্রাহিম ইবনে আদহাম একদিন পাশ্ববর্তী জঙ্গলে শিকারে যান। সে সময় এক দাসী রাজপ্রাসাদে তার শয়নকক্ষে এসে দেখলেন বাদশাহর স্ত্রীও সেখানে নেই। রাজার শয়নকক্ষের বহুমূল্যবান আসবাবপত্র, সুশোভিত সুঘ্রাণ মিশ্রিত বিছানা বালিকা দাসীকে আত্মহারা করে তুলল। সে নিজের অবস্থার কথা ভুলে গেল। তাঁর লোভ জাগলো রাজবিছানায় শয়ন করার। অতি সন্তপর্ণে সে রাজবিছানায় শুয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুমন্ত অবস্থায় দাসীকে রাজ বিছানায় দেশে বাদশাহর লোকেরা অবাক বনে গেল। বাদশাহ ইব্রাহিম আদহাম শিকার থেকে বাড়ি ফিরলে তাঁকে এ ঘটনা জানানো হল। দাসীর সাহস দেখে বাদশাহ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন এবং তাকে ৫০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দিলেন।

সাথে সাথে বাদশাহর হুকুম বাস্তবায়ন বাস্তবায়ন করা হল। এসময় বাদশাহ বললেন, হে বালিকা! তুমি তোমার কৃতকর্মের জন্য নিশ্চয় দুঃখবোধ করছো?

বালিকা দাসী উত্তর দিল- হ্যাঁ, মহামান্য বাদশাহ। কিন্তু আমি আমার চেয়ে আপনার জন্যই বরং বেশি দুঃখবোধ করছি।

রাজা উদ্যতস্বরে বললেন, কেন এ অমূলক চিন্তা করছো?

বালিকা দাসী বলল, কিছু সময় রাজ বিছানায় শয়ন করার অপরাধে যদি ৫০টি বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয় তাহলে বছরের পর বছর ঐ বিছানায় শয়ন করার জন্য আপনার কেমন শাস্তি হবে, তা ভেবে আমি দুঃখবোধ করছি।

বালিকা দাসীর কথায় বাদশাহর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলে। মনে হল এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বাদশাহ ইব্রাহিম আদহামের চেহারা পাল্টে গেল। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার সকল পরিচারিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাকে এখান থেকে নিয়ে যাও এবং উত্তম চিকিৎসা প্রদান করো। আর আমাকে একাকি থাকতে দাও।

বাদশাহীর আমলে এক রাতে ইব্রাহিম বিন আদহাম পালঙ্কে বিশ্রাম নিচ্ছেন। হঠাৎ তার প্রাসাদের ছাদের উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। দ্রুত বিছানা ছেড়ে প্রাসাদের ছাদে চলে গেলেন। ছাদে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন একজন সাধা-সিধে মধ্যবয়সী লোক তার ছাদে পায়চারী করছে। ইব্রাহীম আদহাম জিজ্ঞেস করেন: “তুমি কে?”

লোকটি উত্তর দিল: “জাহাঁপনা! আমার উটটি হারিয়ে গেছে, এখানে খুঁজতে এসেছি।”

ইব্রাহীম বললেন : “ওহে নির্বোধ! কেউ কখনো ছাদের উপরে উট খোঁজে নাকি? উটের কি পাখা আছে যে, তা উড়ে এসে আমার ছাদে বসে থাকবে? উট এখানে কি করে আসবে?”

লোকটি উত্তরে বলল : “হ্যাঁ, জাহাঁপনা! ছাদের উপর উটের খোঁজ নেয়া একটি আশ্চর্য ও বোকামিপূর্ণ ব্যাপারই বটে। তবে, আর তাঁর চেয়ে অনেক বেশী বিস্ময়কর হচ্ছে আপনার কাজ। আপনি কি করে সোনালী সিংহাসনে বসে ও চকচকে রেশমী পোশাক পরে আল্লাহর সন্ধান করছেন?” 

ছাদ থেকে ভেসে আসা এ কথাগুলো শুনে হযরত ইব্রাহিম বিন আদহাম বুঝে ফেললেন, মূলত লোকটি কোনো উটের মালিক নয় বরং উটের মালিকের বেশ ধরে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতা। তাঁকে মহান আল্লাহ আরো বেশী আপন করার জন্য পথপ্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছেন।

বাদশাহ ইব্রাহিম আদহাম ভাবলেন, আজ আমাকে যে কথা শোনানো হলো তাতো ঠিকই। কারণ মহান আল্লাহকে পেতে হলে কঠোর সাধনা ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন। কিন্তু আমি তো এখনো বাদশাহী আয়েশী জীবন পরিত্যাগ করতে পারিনি। রাজকীয় সুখ-সম্ভোগে লিপ্ত থেকে কি আর আল্লাহপাকের প্রিয়ভাজন হওয়া যায়?

এসব চিন্তা-ভাবনা করার পর তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। তাঁর সমস্ত শরীরে এক নব বিপ্লবের স্পন্দন অনুভব করলেন। নিমিষেই সমস্ত শরীর ঘেমে গেল। তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চিরদিনের জন্য তিনি রাজসিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন পরম করুণাময় আল্লাহপাকের সন্ধানে।

কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি তার একজন দাসের সাক্ষাৎ পেলেন। তখন তার দাস তারই ভেড়ার পাল দেখাশোনা করছিল। তিনি সেখানেই তার অতি সুন্দর ও মহামূল্যবান পোশাক দাসকে দিয়ে নিজে দাসের গায়ের রাখালি পোশাক পড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।

ইব্রাহিম আদহাম ও মুসাফির

একবার বাদশাহ ইব্রাহিম আদহাম দেশের সকল গণ্যমান্য লোকজন, মন্ত্রিবর্গ, উপদেষ্টা পরিষদ ও দাস-দাসী এবং সকল পাইক-পিয়াদাকে রাজদরবারে আহ্বান করলেন। রাজার গোলামরা সারিবদ্ধভাবে বুকে হাত রেখে বিনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ একজন অপরিচিত ব্যক্তি কারো কাছে অনুমতি না নিয়েই দরবারে প্রবেশ করল। ঐ ব্যক্তির ভাব গম্ভীরতা দেখে কারো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি যে, ‘আপনি কে? এখানে আপনার কী কাজ?’ লোকটি সোজা গিয়ে বাদশাহর সামনে উপস্থিত।

বাদশাহ্ ইব্রাহীম চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: “তুমি কি জন্য এখানে এসেছো?”

আগন্তুক : “এটা হচ্ছে সরাইখানা আর আমি মুসাফির। সরাইখানা মুসাফিরদের জন্যে বিশ্রামের জায়গা। আমি এখানে এসেছি সামান্য বিশ্রাম নেয়ার জন্যে।”

বাদশাহ্ ইব্রাহীম রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি বলেন: “এটা সরাইখানা নয়। এটা আমার রাজপ্রাসাদ।”

লোকটি বলল : “এই বাসস্থান তোমার পূর্বে কার বাড়ী ছিল?”

ইব্রাহীম একজনের নাম বললেন। আগন্তুক জানতে চাইল: “তার পূর্বে এই বাড়ীর মালিক কে ছিল?”

ইব্রাহীম এবার আরেকজনের নাম বললেন। তা শুনে আগন্তুক বলল “এই যারা এই বাড়ীর মালিক ছিল তারা এখন কোথায়?”

বাদশাহ্ বললেন: “তারা সকলে মারা গেছে আর এটা এখন আমাদের হস্তগত হয়েছে।”

আগন্তুক বলল: “যে বাড়ী প্রতিদিন একেক জনের বাসস্থান, যে বাড়ীতে তোমার পূর্বে অন্যেরা এখানে বসবাস করেছে আর তোমার পরে আরো কত লোক এখানে বসবাস করবে -তা সত্যিকার অর্থে সরাইখানা। কেননা প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে এটা একেক জনের বাসস্থান।”

বাদশাহ্ ইব্রাহীম লোকটির কথা শুনে চিন্তামগ্ন হয়ে গেলেন। তিনি জানতে পারলেন যে, প্রতিপালক তাকে এই বাড়ি অথবা অন্য বাড়ীর জন্য সৃষ্টি করেননি। তাকে অবশ্যই আখেরাতের বাসস্থানের চিন্তা করা উচিত, কেননা সেটা যে চিরস্থায়ী আবাসস্থল।

আধ্যাত্মিকতা

বন্ধুরা, এবার আমরা ইব্রাহিম আদহামের একটি কারামত উল্লেখ করব। দেশভ্রমণের জন্য একবার তিনি সাগর তীরে বসে গায়ের আলখেল্লায় তালি দিচ্ছিলেন। এসময় তাকে দেখতে পান পূর্বে তার অধীনস্ত ছিল এমন এক আমীর।

তিনি ইব্রাহিম আদহামের দুরবস্থার জন্য আফসোস করতে থাকেন। এসময় তাকে আধ্যাত্মিক রাজত্বের রহস্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্য হাতের সুইটি সাগরে ছুঁড়ে দিলেন ইব্রাহিম আদহাম। একটু পরেই শত শত মাছ মুখে একটি করে স্বর্ণমুখি সুই নিয়ে পানির উপরে ভেসে উঠে ও ইব্রাহীম আদহামের কাছে ভিড় করে। ইব্রাহিম এখন আমীরের দিকে তাকিয়ে বললেন: আচ্ছা বলুন তো, আধ্যাত্মিক রাজত্ব অধিক গুরুত্বপূর্ণ নাকি সিংহাসন?

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি আবৃত্তি। 'আমার পণ' কবিতাটি আবৃত্তি করেছে বাংলাদেশি বন্ধু নাভীন। 

বন্ধুরা, অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে থাকবে একটি গান। 'কতদিন দেখিনা মায়ের মুখ' শিরোনামের বিখ্যাত গানটির গীতিকার: নুরুজ্জামান শেখ, সুরকার: বদরুল আলম বাকু আর গেয়েছে শিশুশিল্পী ইমরান।

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদাই নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ