অক্টোবর ১৫, ২০২৩ ২০:০৫ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি ভালো ও সুস্থ আছো। বরাবরের মতোই আজকের আসরে তোমাদের সঙ্গে আছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই রয়েছে কয়েকটি শিক্ষণীয় গল্প। গল্পের পর থাকবে একটি কবিতা। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তো প্রথমেই শিক্ষণীয় গল্পগুলো শোনা যাক।

(হাঙরের টোপ)

এক সামুদ্রিক প্রাণিবিজ্ঞানী একটি হাঙর নিয়ে পরীক্ষা চালালেন। তিনি হাঙরটিকে রাখলেন একটি বড়সড় পানির ট্যাংকে। তারপর টোপ হিসেবে সেটাতে কিছু ছোট মাছ ছেড়ে দিলেন। যা ঘটার সেটাই হল। হাঙরটি সাঁতরে ছুটে এলো। আক্রমণ করল ছোট মাছগুলোকে। একে একে সব ছোট মাছ খেয়ে ফেলল।

এবার জীববিজ্ঞানী শক্ত স্বচ্ছ কাচের একটি দেয়াল দিয়ে ট্যাংকটিকে দুই ভাগ করলেন। তিনি হাঙরটি রাখলেন এক অংশে। অন্য অংশে রাখলেন নতুন কিছু ছোট মাছ।

হাঙরটি এবারও ছোট মাছগুলোকে আক্রমণ করতে দ্রুত ছুটে এলো। কিন্তু ঠোক্কর খেল শক্ত স্বচ্ছ কাচে। আবারও হাঙরটি চেষ্টা করল। কিন্তু কাচের দেয়ালে ঠোক্কর খেল আবারও। এভাবে বারবার আক্রমণের চেষ্টা চালাল হাঙরটি। ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এলেও থামল না।

ট্যাংকের অন্যপাশে ছোট মাছগুলো অক্ষত থাকল। মাছগুলো সাঁতার কাটছিল নির্বিঘ্নে নির্ভাবনায়। বারবার আক্রমণ করে প্রায় একঘণ্টা পর হাঙরটি অবশেষে ক্ষান্ত দিল।

জীববিজ্ঞানী এই পরীক্ষাটি কয়েক সপ্তাহ চালালেন। প্রতি সপ্তাহেই বারো-তেরবার পরীক্ষা চালাতেন। প্রতিবারই হাঙরটি আক্রমণের ইচ্ছে একটু একটু করে হারিয়ে ফেলছিল। এমনকি হাঙরটি একসময় ক্লান্ত হয়ে মাছগুলোকে আক্রমণ করা বন্ধই করে দিল।

জীববিজ্ঞানী এবার শক্ত কাচের দেয়ালটি সরিয়ে ফেললেন। দেখলেন, এরপরও হাঙরটি আক্রমণ করছে না। হাঙরটির মনে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, তার ও ছোট মাছগুলোর মধ্যে একটি দেয়াল দেয়া আছে।

বন্ধুরা, এই গল্পের নীতিকথা হচ্ছে, ব্যর্থ হলেই মিথ্যে প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে হাল ছেড়ে দিতে নেই। চেষ্টাই সাফল্যের চাবি।

(না জেনে কিছু করতে হয় না)

এক নদীতে এক জেলে জাল দিয়ে মাছ ধরছিল। এক বানর কাছাকাছি এক গাছে বসে তা দেখে আনন্দ পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ মাছ ধরার পর জেলে বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটু দূরে গিয়ে বসল। বানরের ইচ্ছা হল, সেও জেলেদের মতো জাল দিয়ে মাছ ধরবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। সে গাছ থেকে নিচে নেমে জালের কাছে গেল। জাল ধরে সে নাড়াচাড়া করে তা পানিতে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু তার জাল মারা হল না। উল্টো সে জালে জড়িয়ে আটকে গেল। বহু চেষ্টা করেও বানর জাল থেকে বের হতে পারল না। সে বুঝতে পারল, এখান থেকে বের হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই। মুক্ত হওয়ার আশা ছেড়ে দিল সে।

এদিকে জেলে এসে যখন জালের ভেতর বানরটিকে দেখল, তখন সে রেগে গেল এবং তাকে আচ্ছাতর শাস্তি দিল। বানর মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলল, ‘আমি মাছ ধরার কিছুই না জেনে জালে হাত দেয়ার উপযুক্ত শিক্ষাই পেলাম।’

(অতিচালাকির ফল)

একদিন এক অতি চালাক নেকড়ে ঠিক করল সে ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজের চেহারাটা পাল্টে ফেলবে, তাহলে তার আর খাদ্যের ভাবনা থাকবে না। সহজেই শিকার ধরে ধরে খেতে পারবে।

যে কথা সেই কাজ। নেকড়ে একটা ভেড়ার চামড়া গায়ে মুড়িয়ে ভেড়ার পালের মধ্যে ঢুকে গেল আর তাদের মতোই ঘাস খাওয়ার ভান করতে লাগল। ক্রমেই সন্ধ্যা হয়ে এল। রাখাল তার ভেড়ার পালকে তাড়িয়ে নিয়ে খোঁয়াড়ে পুরে রাখল।

এদিকে সেদিন রাখালের বাড়িতে মেহমান এসেছিল। তাই তার মাংসের প্রয়োজন হওয়ায় একটা ভেড়া তাকে জবাই করতেই হবে। তাই সে একটা ভেড়াকে বের করে দড়ি দিয়ে আলাদা করে বেঁধে রাখল। তাকে কিছু খেতেও দিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই ভেড়াটা আসলে ভেড়া ছিল না। সেটি ছিল ছদ্মবেশধারী সেই নেকড়ে। রাতে যথাসময়ে তাকেই জবাই করা হল।

বন্ধুরা, দেখলে তো, চালাকি করতে গিয়ে নেকড়ের কী পরিণতি হলো?

(উপকারীর সমালোচনা নয়)

সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। ভীষণ গরম। চারিদিক শুকিয়ে খট্খটে হয়ে গেছে। এই ঠা ঠা রৌদ্রে কয়েকজন পথিক পথ চলতে গিয়ে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাদের পা আর চলতে চাইছিল না। এমন সময় পথের ধারে এক বিশাল বটগাছ দেখতে পেয়ে তারা সেই গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়ে ঠাণ্ডা হল, তাদের ক্লান্তিও দূর হল।

গাছটির দিকে তাকিয়ে তাদের একজন বলতে শুরু করল- কি বিশাল গাছ! অথচ এর না-আছে সুন্দর ফুল না-আছে ভালো ফল! আর ফলগুলোও অতি ক্ষুদ্র। এসব গাছ মানুষের কী উপকারে আসে? বলতে বলতে তার মাথায় এসে একটা বটের ফল পড়ল টুপ করে।

বটগাছটা বলল, ‘মানুষের মতো অকৃতজ্ঞ জীব পৃথিবীতে আর নেই। আমার ছায়ায় বসে গা জুড়িয়ে সুস্থ হলে- আর অকৃতজ্ঞের মতো বললে আমি মানুষের কোনো কাজে আসি না। তোমার মাথায় যে ফলটি পড়ল তা যদি নারিকেল বা কাঁঠালের মতো হতো, তোমার কী অবস্থা হতো!  

(ধৈর্যের ফল ভালো হয়)

এক বনে একটি মহিষ ছিল। কয়েকটি দুষ্টু বানর তাকে নানাভাবে খ্যাপাতো। কেউ তার লেজ ধরে টান দিয়ে দৌড় মারতো, কেউ আবার গাছ থেকে নারিকেল, বেল এসব ছুড়ে মারতো তার গায়ের ওপর। কেউ আবার লাফিয়ে তার পিঠের ওপর বসে চিমটিও কাটতো। কিন্তু মহিষটি বানরদের কিছুই বলত না।

তার এ অবস্থা দেখে বনের অন্য পশুরা তো অবাক! কী ব্যাপার মহিষটি ওদের আচ্ছামতো শিক্ষা দিচ্ছে না কেন? একটি হাতি তার কাছে গিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে বসলো।

তখন মহিষ মুচকি হেসে জবাব দিল- আমি আসলে ওই বানরগুলোর কাছে ঋণী। কারণ ওরা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, কিভাবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। এটা শুনে লজ্জায় লাল হওয়া বানররা তার কাছে এসে ক্ষমা চাইল।

(গোঁয়ার দুই ছাগল)

একদিন সরু একটি সাঁকোর দুই মুখে হাজির হল দুই ছাগল। দুটিই খুব গোঁয়ার। এক ছাগল চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি আগে সেতু পার হব। আমাকে আগে যেতে দাও।’

অন্য ছাগল আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তা হবে না। আমি আগে পার হব। আমার রাস্তা থেকে সরে যাও!’

কিন্তু কেউ কারও কথা মানল না। মুখোমুখি হল সেতুর মাঝখানে। তুমুল ঝগড়া দুজনের। তারপর গুঁতোগুঁতি। ভারসাম্য হারাল দুজনই। নিজেদের সামলাতে না পেরে পড়ে গেল স্রোতের মধ্যে। ডুবে মরে গেল দুজনই।

কয়েকদিন পর অন্য দুটি ছাগল এলো সরু সেতুর দুই ধারে। পার হওয়ার সময় মুখোমুখি হল তারা। কিন্তু ওরা কেউ গোঁয়ার্তুমি করল না। তারা ছিল বুদ্ধিমান ও শান্ত। ধৈর্য ধরে একজন আরেকজনকে যাওয়ার রাস্তা করে দিল। এভাবে নিরাপদে সরু সেতু পার হয়ে গেল দুজনই।

বন্ধুরা, এই নীতিকথা গল্পের মূলকথা হলো- রাগের চেয়ে নমনীয়তা অনেক ভালো।

(দুই প্রতিবেশী)

এক ছিল জ্ঞানী লোক। শুধু জ্ঞানেই নয়, ধনেও বড়লোক। একবার বিরাট এক বাগান কিনলেন তিনি। সেই বাগানে ছিল খুব সুন্দর একটি বাড়ি।

কিন্তু সব কিছুই তার জন্য সুখের ছিল না। তার বাড়ির পাশেই ছিল একটি পুরানো বাড়ি। সেই বাড়িতে বাস করতেন এক হিংসুটে লোক। প্রতিবেশী হিসেবে মোটেও সুবিধের নন। সুন্দর বাড়ির লোকটির পেছনে অনবরত লেগে থাকতেন। তার সুখী জীবন দুর্বিষহ করে তোলার চেষ্টা করতেন যতদূর সম্ভব। ময়লা-আবর্জনা তার গেটের ভেতর ফেলতেন। আরও ফেলতেন নানা নোংরা জিনিস।

এক সুন্দর সকাল। জ্ঞানী লোকটি ঘুম থেকে জাগলেন। আজ তার মন খুব ভালো। ফুরফুরে মেজাজে গেলেন বারান্দায়। দেখলেন, সেখানে ঝুড়ি ঝুড়ি আবর্জনা ফেলা রয়েছে। অনেক নোংরা জিনিস ছড়ানো ছিটানো চারদিকে।

জ্ঞানী লোকটি একটি ঝুড়ি নিলেন। পরিষ্কার করলেন বারান্দার ময়লা আবর্জনা। তারপর একটি ঝুড়ি নিয়ে চললেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। হিংসুক প্রতিবেশীর দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি।

হিংসুক লোকটি কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেন। উৎফুল্ল হয়ে ভাবলেন, ‘শেষ পর্যন্ত লোকটাকে তাহলে জব্দ করতে পেরেছি!’

দরজা খুলতে এগিয়ে এলেন হিংসুক লোকটি। মনে মনে তৈরি হলেন ধনী প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়ার জন্য। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। দরজা খুলতেই দেখলেন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন জ্ঞানী লোকটি। একঝুড়ি টাটকা আপেল বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘নিন, আমার বাগানের আপেল। যার যা আছে তিনি তো তা-ই অন্যকে দেবেন, তাই না!’

জ্ঞানী লোকটির কথা শুনে লজ্জা পেলেন হিংসুক লোকটি। এভাবে নিজেই জব্দ হলেন।

বন্ধুরা, এই গল্পের নীতিকথা হচ্ছে, অযথা অন্যকে জব্দ করতে গেলে নিজেই লজ্জায় পড়তে হয়।

(অহেতুক সন্দেহ)

একদিন দুটি ছোট ছেলে একসঙ্গে খেলছিল। তারা দুই বন্ধু। একজনের কাছে ছিল কাচের অনেক মার্বেল। নানা রঙের। সেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। অন্যজনের কাছে ছিল অনেক চকোলেট। নানা রঙের মোড়কে মোড়ানো। প্রথম বন্ধু তার সব মার্বেল অন্য বন্ধুকে দিতে চাইল। বিনিময়ে নিতে চাইল তার সব চকোলেট।

এ শর্তে দ্বিতীয় বন্ধু রাজি হল। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে সব মার্বেল দিয়ে দিল। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর আর বড় মার্বেলটি নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল। শর্ত অনুযায়ী দ্বিতীয় বন্ধু তার সব চকোলেট দিয়ে দিল প্রথম বন্ধুকে।

সেই রাতে দ্বিতীয় বন্ধু খুব আরামেই ঘুমাল। কিন্তু প্রথম বন্ধুটি কিছুতেই ঘুমাতে পারল না। সারা রাত তার মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেল- হয়তো তার মতোই দ্বিতীয় বন্ধুটিও আরও মজাদার কিছু চকোলেট তাকে না দিয়ে রেখে দিয়েছে নিজের জন্য। যেভাবে সে নিজেও নিজের জন্য সবচেয়ে বড় ও সুন্দর মার্বেলটি রেখে দিয়েছে।

বন্ধুরা, এই গল্পের নীতিকথা হচ্ছে, কাউকে শতভাগ না দিলে নিজেও শতভাগ না পাওয়ার দুশ্চিন্তা থাকে।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি আবৃত্তি। 'তখন সত্যি মানুষ ছিলাম' শিরোনামের কবিতাটি লিখেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। আর আবৃত্তি করেছে ঢাকার সারেগামা একাডেমির সদস্য নানজিবা ফাইরুজ সিলমি। 

বন্ধুরা, সিলমির চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। এবার রয়েছে 'ফিলিস্তিনের আর্তনাদ' শিরোনামের একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন এবং সুর বরেছেন আব্দুল গাফফার। আর গেয়েছে শিশুশিল্পী হুমায়রা আফরিন ইরা।  

ইরার আবেগমাখা কণ্ঠে গানটি শুনলে। ফিলিস্তিনি শিশুরা স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পাক- এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আসর আসর।

কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে। সে পর্যন্ত ভালো ও সুস্থ থেকো।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ