ফিলিস্তিন পরিস্থিতি
'গাজাকে নিশ্চিহ্ন করতে গেলে ইসরাইল ধ্বংস হয়ে যাবে'
শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। বর্তমানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় অর্থাৎ টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ড হচ্ছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী সংগঠন হামাসের ইসরাইলে দুঃসাহসিক হামলা-যে হামলায় তের শ'র বেশি ইসরাইলি নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় দু হাজার সাত শ পঞ্চাশ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
গাজায় মৃতের সংখ্যা মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়ছে। সেখানে কেবল লাশ আর লাশ। এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। গাজায় ইসরাইলি বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল করছে। বিশ্বের অনেক দেশ নড়েচড়ে বসেছে।
বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে রক্তক্ষয় প্রলম্বিত হবে। হামাস হামাস কেন এই মুহূর্তে ইসরাইলে হামলা চালাল? পরিস্থিতি কী হবে- সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিশ্লেষকেরা ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের মিডিয়াগুলো তা প্রচার করছে।
তবে সাধারণভাবে যেসব ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে, সোজাসাপ্টা ভাষায় তা হলো, হামাসের এই অভিযান চালানো ছাড়া সামনে পথও খোলা ছিল না। পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা কী করবে? এ বিষয়ে বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর একটি মতামত কলামের শিরোনাম আমার চোখে পড়েছে- সেখানে লেখা হয়েছে, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: অপরাধের শত বছর, অন্যায়ের ৮০, পাপের ৬৯...এসব বিষয় ইতিহাসে আছে।
তো আজ আমরা এ বিষযে কথা বলব। আর আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও লেখক জনাব আমিনুল ইসলাম শান্ত।
জনাব আমিনুল ইসলাম শান্ত, রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: জনাব আমিনুল ইসলাম শান্ত, ফিলিস্তিনের হামাসসহ প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইহুদিবাদী ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এটা এখনই জরুরি ছিল কিনা? আপনার মত কী?
আমিনুল ইসলাম শান্ত: আমি যদি এককথায় বলি, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাস ইসরাইলে যে হামলা করেছে- এসময়ে সেটি অবশ্যই তারা জরুরি বলে মনে করেছে। হামাস একটি প্রতিরোধ সংগঠন, যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তাদের বেড়ে ওঠা। তারা কখন হামলা করবে কখন করবে না তার নিশ্চয়ই একটি ক্যালকুলেশন আছে। তারা হিসেব নিকাশ ছাড়া এই হামলা করেছে সেটি বলা যাবে না। অবশ্য ইসরাইলে হামাসের হামলার ব্যাপারে একটি বড় ধরনের অঙ্ক আছে। সেই অঙ্ক করেই তারা হামলাটি করেছে। তারা এখন হামলাটিকে জরুরি বলে মনে করেছে। যুদ্ধ অবশ্যই একটি কৌশল একটি গেম আপনি জানেন। তাই সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনা করেই তারা এ ধরনের হামলা করেছে সেটি অন্তত অনুমান করা যায়।
রেডিও তেহরান: আমিনুল ইসলাম শান্ত সবার মাঝে একই প্রশ্ন- ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা এতটা দুঃসাহসিক হয়ে উঠল কী করে? কীভাবে সম্ভব হলো ইসরাইলের ভেতরে অভিযান চালানো?
আমিনুল ইসলাম শান্ত: এখানে একটি বিষয় অবশ্যই আমাদেরকে জানতে হবে সেটি হচ্ছে, তাদের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ইসরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের ভূ-খণ্ড তারা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে উদ্বাস্তু ও শরণার্থী করেছে। ফিলিস্তিনীরা মূলত এখন ঘরহারা, জমিহারা একটি জাতি। সবকিছু মিলিয়ে তারা আজ যে পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে তাতে তাদের আর বিকল্প কিছু নেই। যুদ্ধ, রক্ত দেখতে দেখতেই তাদের জীবন গড়ে উঠেছে। যুদ্ধে তারা তাদের সন্তান প্রিয়জনকে হারিয়েছে প্রতিদিন। এ অবস্থায় তাদের পীঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে।
এছাড়া আরেকটি বিষয় আপনি জানেন যে, ঐতিহাসিকভাবে ধর্মযুদ্ধ স্বীকৃত। অতীত ইতিহাস বলে খৃষ্টানরাও ধর্মযুদ্ধ করেছে। আমরা যদি ক্রুসেডের কথা বলি। তাহলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনই এখানে শুধু ফ্যাক্টর নয় একদিকে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন বা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি পাশাপাশি ধর্ম একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। কারণ এখানে মসজিদুল আকসা রয়েছে। সেখানে মুসলমানদের যেতে দেয়া হয় না। সেটিকে কেন্দ্র করেই ফিলিস্তিনীরা ক্ষুব্ধ। হামাস যে আক্রমণ চালিয়েছে তার নামও কিন্তু দিয়েছে যে, 'অপারেশন আল আকসা স্টর্ম/ফ্লাড'। আর ধর্মীয় বিষয়গুলো যখন মানুষের মধ্যে কাজ করে তখন তারা কিন্তু যুদ্ধের জন্য একটা অন্যরকম প্রেরণা পেয়ে থাকে। আর সেটি তাদেরকে অবশ্যই অনেক বেশি সাহস যুগিয়েছে বলে আমি মনে করি।
শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ নিয়ে সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব, শান্ত- এই অভিযানের পর ইসরাইল হুমকি দিয়েছে গাজাকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আপনার কী মনে হয়?
আমিনুল ইসলাম শান্ত: গাজার এবং ইসরাইলের যে মানচিত্র তার প্রত্যেকটি ছবি ধরে ধরে আমি বারবার স্টাডি করেছি। ইসরাইল চাইলেই ফিলিস্তিনকে পুরো দখল করে নিতে পারে, তার আয়ত্বের মধ্যে আছে। খুব সহজেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে চাইলেই। ইসরাইলের কাছে সেই ধরনের গোলা বারুদ, অস্ত্র সবই রয়েছে কিন্তু যে প্রতিবন্ধকতাটি তাকে এই কাজটি করতে বারণ করবে সেটি হচ্ছে তারা গাজাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না; মরুভূমি করতে পারবে না, জনমানবহীন করতে পারবে না। সেটি করতে গেলে ইসরাইলকেও একইধরনের নিশ্চিহ্ন হবার হুমকিতে পড়তে হবে। কারণ এখানে হামাসকে সমর্থন করে এমন অনেক রাষ্ট্র এবং জোট রয়েছে। বিশেষ করে ইরান এবং তার যে প্রক্সি নেটওয়ার্ক সেটি শুধুমাত্র ইরানের আশেপাশে নয় পুরোপুরি ইসরাইল তার আওতাভুক্ত। ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক কিন্তু ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করার মতো পদক্ষেপ নেবে। কারণ গাজা যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তখন একইভাবে ইসরাইলও নিশ্চিহ্ন হবার হুমকিতে পড়বে। আর সেই হুমকি বিবেচনা করেই তারা এই যুদ্ধকে একটা লিমিটেড পর্যায়ে রাখবে। মুখে পুরোপুরি গাজাকে নিশ্চিহ্ন করার কথা বললেও তাদের কথাকে কেবল হুমকি হিসেবে বিচেনা করছি। সেটি করতে পারবে না।
রেডিও তেহরান: জনাব, আমিনুল ইসলাম শান্ত সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, এই যুদ্ধের পরিণতি কী? সম্ভাব্য কী প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে?
আমিনুল ইসলাম শান্ত: মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধে প্রভাবের কথা বিবেচনা করলে আমরা দেখব সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছিল মধ্যপ্রাচ্যে। সবেমাত্র সিরিয়া সেই যুদ্ধ থেকে যখন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং এমন একটি সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব হারাতে বসেছে ঠিক সেই সময় এসে এ ধরনের একটি যুদ্ধকে পশ্চিমারা একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে নিয়েছে। তারা এখানে পুনরায় তাদের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে হাজির হতে চায়। তাছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের যে গ্লানি সেটিকে ঘোচাতে এই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে পরাশক্তিগুলো এখানে আবার নতুন করে সক্রিয় হতে চায়। সেটি ফিলিস্তিনের পক্ষে যারা রয়েছে তাদের জন্যও যেমন ঠিক তেমনি ইসরাইলের পক্ষে যারা রয়েছে তাদের জন্যও। আর সেটি হলে পুনরায় মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। আর সেই বিশৃঙ্খলার পথ কতদূর গড়াবে, কবে এর সমাধান হবে সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যে যে একটি বিশৃঙ্খলা বাঁধিয়ে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা-তারই একটা নতুন পথ তৈরি করবে।
রেডিও তেহরান: তো জনাব আমিনুল ইসলাম শান্ত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমিনুল ইসলাম শান্ত: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/জিএআর/১৬