অক্টোবর ২৩, ২০২৩ ২০:০৯ Asia/Dhaka

শ্রোতা ভাইবোনেরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। শেষ ত্রাণকর্তা শীর্ষক নতুন ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম পর্বে সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

বিশ্বজুড়ে দারিদ্র, বঞ্চনা, অনাচার, দুরাচার, কুসংস্কার, যুদ্ধ, নৈরাজ্য, বৈষম্য আর অসাম্যের শৃঙ্খলে বন্দী মানবতা মুক্তির প্রহর গুনছে যুগ যুগ ধরে। যুগে যুগে মুক্তির খোদায়ি পথ প্রদর্শক তথা খোদায়ি সংস্কারক ও মহামানব হিসেবে এসেছেন অনেক নবী ও রাসুল এবং তাঁদের প্রতিনিধি। নবী-রাসুলদের কল্যাণে মাঝে মধ্যে শান্তির সুশীতল বাতাস বইলেও মানবজাতি আজও বিশ্বজুড়ে স্থায়ী শান্তি, সাম্য, উন্নয়ন, ঐক্য, মুক্তি, স্বাধীনতা ও সার্বিক কল্যাণের ধারা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়নি বরং বিশ্বের বহু অঞ্চল জুড়ে এখনও চলছে অশান্তি, যুদ্ধ, অবিচার ও অনৈতিকতার রাজত্ব। কিন্তু বিশ্বজুড়ে সবার জন্য সার্বিক কল্যাণের ধারা বইয়ে দেয়ার মত মহামানব তথা মানব-জাতির শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের আশা বুকে নিয়ে মানব জাতির বঞ্চিত ও নির্যাতিত অংশ অতীতের জাতিগুলোর মত আজও দেখছেন মুক্তির স্বপ্ন। তারা মনে করেন এমন একজন ঐশী ত্রাণকর্তা অবশ্যই  আসবেন যিনি মানুষকে মুক্ত করবেন সব দুষ্কৃতি, অন্যায়, জুলুম ও বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে এবং মানুষের জন্য তিনি বয়ে আনবেন সর্বোচ্চ সম্মানজনক ও সৌভাগ্যময় জীবন। 

মহান আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ ধর্ম ও মুক্তির সর্বশেষ অথচ সর্বোত্তম ও পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান নিয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগে এক উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে গড়ে উঠলেও সেই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাও ইসলামী আদর্শের মূল-ভিত্তিগুলোর ওপর বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। ফলে দেখা দিয়েছে গৃহযুদ্ধ এবং কারাবালার রক্তাপ্লুত ঘটনাসহ মহা-বিষাদময় নানা ঘটনা। এ ছাড়াও মুসলিম দেশগুলোর ওপর বয়ে গেছে ক্রুসেড, হালাকু-চেঙ্গিসের গণহত্যা ও উপনিবেশবাদের মহা-বিপর্যয় যার ধকল এখনও বয়ে চলছে মুসলিম বিশ্ব। ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, কাশ্মীর ও অন্য অনেক সংকট থেকে বোঝা যায় বিশ্ব-শান্তি ও মানবজাতির ঐক্য এখনও খুব কাছের বিষয় নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ অন্যান্য ধর্মের ওপর ইসলামের কর্তৃত্ব ও সারা বিশ্বের ওপর ন্যায়পরায়ণদের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্বের জনসংখ্যার বেশিরভাগ আজও অমুসলিম। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির সুফল এবং বিশ্বের নানা সম্পদের সুষম বণ্টন থেকে আজও বঞ্চিত রয়েছে নানা জাতি।  

মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা সব ধর্মেই দেখা যায়। ইসলামী নীতি তথা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মহানবী (সা)'র পবিত্র বংশধারায় জন্ম-নেয়া মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হলেন হযরত ইমাম মাহদি (আ)। শেষ ত্রাণকর্তা বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনায় আমরা এ মহামানবের আগমন ও তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের কর্তৃত্ব বিস্তার ও সভ্যতার চরম বিকাশ ও তাঁর আগমনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সক্রিয় ব্যক্তি তথা ইমাম মাহদির জন্য অপেক্ষমানদের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাতের চেষ্টা করব। তবে তার আগে শেষ যামানার শেষ ঐশী ত্রাণকর্তার ধারণাগুলো সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করব যাতে এ বিষয়টি বোঝা সহজ হয়। 

বিশ্বের মানুষের মধ্যে তথা মানবজাতির এক বড় অংশ সব সময়ই নৈরাশ্যের নীতিতে বিশ্বাসী। তাদের মতে জুলুম-অবিচার, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার আর শোষণ-এসব থেকে মানবজাতির কোনো মুক্তি নেই। মানবজাতিকে শেষ পর্যন্ত এইসব যন্ত্রণা নীরবে সয়ে যেতেই হবে। শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা একটি কল্পনা মাত্র বা আত্ম-সান্ত্বনা মাত্র। 

অন্যদিকে পার্থিব জীবনের পর পরকাল ও অপার্থিব জগতে বিশ্বাসী মানুষেরা মনে করেন এই পার্থিব জীবনই মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায় নয়। পার্থিব জীবনেও চরম সংকটের পরেও রয়েছে শান্তি ও মুক্তির সোনালী অধ্যায়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ জালিমের জুলুম মেনে না নিতে মজলুম ও বঞ্চিতদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। তাই জন্মই আমাদের আজন্ম পাপ-এমন নৈরাশ্যময় বস্তুবাদী চিন্তা কোনো বিশ্বাসীর জীবন-দর্শন হতে পারে না। জালিমের জুলুম আল্লাহর পক্ষ থেকেই মানুষের ভাগ্য-লিপি- ইসলাম এমন ধারণার বিরোধী। তাই অন্যায়ের সঙ্গে চিরকাল আপোষ করে যাওয়াই ভালো-এমন নৈরাশ্যবাদী বা কথিত ভাগ্য-লিপির অখণ্ডনীয় দণ্ডকে নতশিরে মেনে নেয়ার কাপুরুষোচিত নীতি মুসলমানের ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণেই মুসলমানরা সংস্কারকের উত্থান ও ইমাম মাহদির আগমনের নীতিতে বিশ্বাসী। এই নীতি মুসলমানদের সংগ্রামী চেতনাকে শানিত করে ও মুক্তির ব্যাপারে তাদের আশাবাদী করে। তাই  মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে একদিন বিশ্বব্যাপী সত্য ও সুন্দরের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে এবং এভাবে মানব-সভ্যতা পূর্ণতা পাবে। আর ওই বিশ্ব-বিপ্লবের নেতা হবেন মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদি (আ)। 

মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদির (আ) আবির্ভাব বা এ ধরনের নেতার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী কেবল ইসলাম ধর্মের নীতিমালা ও বই-পুস্তকে দেখা যায় তা নয়, অন্যান্য খোদায়ি ধর্মের বক্তব্যের মধ্যেও এমন ভবিষ্যদ্বাণী দেখা গেছে। আর খোদায়ি ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি কখনও মিথ্যা হয় না। সভ্যতার গতি-ধারা থেকেও এটা স্পষ্ট যে তা অবশ্যই  এক সময় পূর্ণতা পাবে। কারণ মানব-প্রকৃতিও পূর্ণতাকামী। মানুষের সব মহতী গুণ ও সৃষ্টিশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ তাই অবশ্যম্ভাবী। মানুষ ক্ষমতা, খ্যাতি ও সম্পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে চায়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসহ সবক্ষেত্রে মানুষ পূর্ণতা চায়। তারা চায় রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি সাধনে হবে পুরোপুরি সক্ষম। তাদের প্রকৃতি অন্যদের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক চায় ও মজলুম মানুষকে তারা সহায়তা দিতে চায়। তাই আমরা দেখছি মজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন বিশ্বের সব অঞ্চল ও সব ধর্মের অনুসারী মুক্তিকামী ও বিবেক-সচেতন মানুষ। মানবজাতির সার্বিক উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়েছে মানবতাকামী মানুষ। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা অনেক সময় খুব একটা সফল হয়নি। 

মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য হল মানুষ সব ক্ষেত্রে উন্নয়নকামী হলেও পশুরা কখনও তাদের স্বভাবগত ও প্রকৃতিগত স্থিতিশীল অবস্থার উন্নতির জন্য কিছু করতে সক্ষম নয় যদিও পশুদের জন্যও রয়েছে তাদের অবস্থার আলোকে নিজস্ব পরিপূর্ণতার পর্যায়। অন্য কথায় পশুরাও তাদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ উন্নতি বা পূর্ণতার প্রত্যাশী। আর মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। অবশ্য মানুষের সার্বিক উন্নতি ও পূর্ণতা তথা সভ্যতার আদর্শ পর্যায়ে পৌঁছানো তথা সব ধরনের সৌভাগ্য অর্জন একজন ন্যায়বিচারকামী ব্যক্তি, খোদাভীরু এবং সার্বিক যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। সব ধরনের গুণের অধিকারী এমন ব্যক্তির তথা ইমাম মাহদির আবির্ভাবের জন্য মানব-জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তারা মহান আল্লাহর কাছে নিয়মিত প্রার্থনাও করছেন এই আশা পূরণের লক্ষ্যে। ওই ত্রাণকর্তা বিশ্ব থেকে সব ধরনের অন্যায় ও মহাপরাক্রান্ত জালিম শক্তিগুলোকে সমূলে বিনাশ করবেন এবং বিশ্বের সব মুক্তিকামী ও সত্য-সন্ধানী মানুষকে সুপথের সন্ধান দিবেন।

 এ ছাড়াও অনেকে মনে করেন বিশ্বে সব সময়ই ঐশী পথ-প্রদর্শকের উপস্থিতি থাকবে। এরই আলোকে ও ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে তারা মনে করেন ইমাম মাহদি উপস্থিত রয়েছেন এবং তিনি অনেক আগেই জন্ম নিয়েছেন যদিও তিনি সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছেন।  নিষ্পাপ নন এমন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে যেসব দুর্বলতা বা নীতিগত বিচ্যুতি দেখা দেয় সেগুলোর সংস্কার বা ক্ষতিপূরণের জন্যও সংস্কারকদের আগমনকে জরুরি মনে করা হয়। আর তাই একজন চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ সংস্কারকের আগমনও অবশ্যম্ভাবী যিনি বিশ্বের সব ন্যায়কামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এবং সবখানে সত্য ও প্রকৃত ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর সুফল সবার জন্য সুলভ করবেন। শ্রোতা ভাই ও বোনেরা, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ ত্রাণকর্তা শীর্ষক প্রথম পর্বের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। একই বিষয়ে আমরা কথা বলব এ অনুষ্ঠানের আগামী পর্বগুলোতে। আশা করছি তখনও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 


 

ট্যাগ