নভেম্বর ০৫, ২০২৩ ১৬:৪৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে বসে আমাদের অনুষ্ঠান শুনছো- সবাই ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো যে, আমাদের সমাজে ধনী ও বিত্তবান লোকের পাশাপাশি গরিব, এতিম, মিসকিন, আশ্রয়হীন ও অসহায় মানুষেরা বাস করে। গরীব-দুঃখীদের দুঃখ-কষ্ট মোচনে সাহায্য-সহযোগিতা করা, দান-খয়রাত এবং সেবা-যত্ন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, “তোমরা যে পর্যন্ত না নিজেদের প্রিয় বস্তু দান-খয়রাত করবে, সে পর্যন্ত কোনো সওয়াব  পাবে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেছেন, “যারা অঢেল ধন-সম্পদ-অর্থ সঞ্চয় করছে, তারা যেন দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার আগেই আল্লাহর নামে দান-খয়রাত করে যেতে থাকে।

অনেকেই আছে যারা সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য না করে উল্টো ধমক দিয়ে বসে। এমনটি করা মোটেও ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, 'তোমরা দান প্রার্থীকে ধমক দিও না।' তিনি আরো বলেছেন, "হে ইমানদারগণ, তোমরা দান গ্রহীতাকে কোনো খোঁটা বা কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-খয়রাত সাহায্য ও সেবাকে বরবাদ করে দিও না।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। তাঁদের কাছে কেউ কিছু চাইলে যা কিছু থাকত তাই দান করে দিতেন। নিজেরা অভুক্ত থেকেও গরিব, এতিম, মিসকিন, অসহায়-অভাবী মানুষদের আহার করাতেন।

বন্ধুরা, দানশীলতার গুরুত্ব নিয়ে এসব কথা বলার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছো! হ্যাঁ, আজ আমরা নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-এর  দানশীলতা সম্পর্কে একটি সত্য ঘটনা শোনাব। আর সবশেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেছেন: “একদিন রাসূলে আকরাম (সা.) আসরের নামাজ আমাদের সাথে আদায় করেন। নামাজ শেষে তিনি কেবলামুখী হয়ে বসেছিলেন এবং লোকজন তাঁর চারপাশে জড় হয়েছিল। তখন পুরনো কাপড় পরিহিত এক বৃদ্ধ সেখানে এলেন। বার্ধক্যের কারণে লোকটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। মহানবী বৃদ্ধ লোকটির সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। এসময় লোকটি বললেন: “ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে অন্ন দান করুন। আমার পরনে ভালো কাপড় নেই, আমাকে বস্ত্র দান করুন। আমি নিঃস্ব, দরিদ্র, আমাকে দয়া করে কিছু দিন।”

রাসূলুল্লাহ বললেন : “আমার কাছে এ মুহূর্তে দেয়ার মত কিছু নেই। তুমি ফাতিমার বাড়িতে যাও। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসে। সে আল্লাহর পথে দান করে থাকে।”

এরপর রাসূলেখোদা হযরত বেলালকে ডেকে বৃদ্ধ লোকটিকে ফাতিমার বাড়িতে পৌঁছে দিতে বললেন। বৃদ্ধ লোকটি হযরত বেলালের সাথে হযরত ফাতিমার গৃহের দ্বারে পৌঁছেন। সেখান থেকেই বৃদ্ধ উচ্চস্বরে বললেন: আসসালামু আলাইকুম, হে নবুওয়তের পরিবার, ফেরেশতাদের গমনাগমনের স্থল, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাযিলের জন্য হযরত জিবরাঈল আমিনের অবতীর্ণ হওয়ার স্থান।

হযরত ফাতিমা উত্তরে বললেন : “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আপনি কে?”

বৃদ্ধ লোকটি বললেন: “আমি একজন বৃদ্ধ আরব, যে কষ্ট ও দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে হিজরত করেছে এবং মানবকুলের মুক্তিদাতা আপনার পিতার পানে ছুটে এসেছে। এখন হে মুহাম্মদ (সা.)-এর দুহিতা! আমি ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন। আমাকে দয়া ও অনুগ্রহ দানে ধন্য করুন। আল্লাহ আপনার উপর রহমত বর্ষণ করুন।”

এ সময় হযরত ফাতিমা, হযরত আলী ও রাসূল (সা.) তিন দিন যাবত কিছু খান নি। নবী করীম (সা.) তাদের অবস্থা ভালো করেই জানতেন। হযরত ফাতিমা দুম্বার চামড়াবিশিষ্ট হাসান ও হুসাইনের বিছানাটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন: হে দরজার বাইরে দন্ডায়মান ব্যক্তি! এটা নিয়ে যাও। আশা করি আল্লাহ তোমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন।

আরব বৃদ্ধটি বললেন : “হে মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা! আপনার কাছে আমি ক্ষুধা নিবৃত্তির কথা বলেছি আর আপনি আমাকে পশুর চামড়া দিচ্ছেন। আমি এ চামড়া দিয়ে কি করব?

হযরত ফাতিমা বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনে হযরত ফাতিমা তার গলার হারটি খুলে বৃদ্ধ লোকটিকে দান করে দিলেন আর বললেন, এটাকে নিয়ে বিক্রি কর। আশা করি আল্লাহ্ তোমাকে এর চেয়ে আরো উত্তম কিছু দান করবেন।

আরব মুহাজির গলার হারটি নিয়ে মসজিদে নববীতে পৌঁছলেন। তখন নবী (সা.) তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে বসে ছিলেন। বৃদ্ধ আরব বললেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই গলার হারটি হযরত ফাতিমা আমাকে দান করেছেন। আর তিনি বলেছেন : “এ গলার হারটি বিক্রি করো। আশা করি আল্লাহ্ তোমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন।”

রাসূলুল্লাহ্ আর চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি বললেন: যে জিনিস সমগ্র নারীকুলের নেত্রী ফাতিমা তোমাকে দিয়েছে- কি করে সম্ভব তার দ্বারা আল্লাহ্ তোমার প্রয়োজন মিটাবেন না?

এসময় হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে কি এই গলার হারটি কেনার অনুমতি দেবেন?

রাসূল (সা.) জবাবে বললেন : “হে আম্মার! এটা ক্রয় কর। যদি সমস্ত জিন ও ইনসান এটা ক্রয়ের মধ্যে অংশগ্রহণ করে আল্লাহ তাদের সকলের উপর থেকে দোজখের আগুন উঠিয়ে নেবেন।”

হযরত আম্মার জিজ্ঞেস করেন : হে আরব বৃদ্ধ! এ গলার হারটি কত বিক্রি করবে?

বৃদ্ধ লোকটি জবাবে বললেন :“এ গলার হারের পরিবর্তে আমার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে, আমি যেন তা দিয়ে কিছু রুটি ও গোশত কিনে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারি এবং একটা কাপড় কিনে আমার দেহ আবৃত করতে পারি যেন সে কাপড় দিয়ে আল্লাহর দরবারে নামাজে দাঁড়াতে পারি। আর কয়েকটি দিনারই যথেষ্ট যা আমি আমার পরিবারকে দিতে পারি।”

হযরত আম্মারের কাছে নবী (সা.) কর্তৃক প্রাপ্ত খায়বরের যুদ্ধের গণিমতের কিছু মাল অবশিষ্ট ছিল। তিনি বলেন : “এ গলার হারের বিনিময়ে আমি তোমাকে বিশ দিনার ও দু’শ দেরহাম, একটি ইয়েমানী পোশাক এবং একটি উট দিবো যার মাধ্যমে তুমি তোমার পরিবারের নিকট পৌঁছতে পার। আর তাতে তোমার ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থাও হবে।”

বৃদ্ধ লোকটি বললেন : হে পুরুষ! তুমি অত্যন্ত দানশীল। অতঃপর সে লোকটি হযরত আম্মারের সাথে তাঁর গৃহে গেল। হযরত আম্মার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সব কিছু সে লোকটিকে দিলেন। বৃদ্ধ লোকটি মালামাল নিয়ে রাসূল (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন : “এখন তোমার ক্ষুধা মিটেছে? তোমার পরিধেয় বস্ত্র পেয়েছো?”

উত্তরে লোকটি বললেন। “জি, হ্যাঁ! আমার প্রয়োজন মিটেছে। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে উৎসর্গ হোক।”

রাসূল (সা.) বললেন : “তাহলে ফাতিমার জন্যে তাঁর অনুগ্রহের কারণে দোয়া কর।”

তখন আরব মুহাজির লোকটি এভাবে দোয়া করলেন: “হে আল্লাহ্! তুমি সর্বদাই আমার প্রভু। তুমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্যের আমি ইবাদত করি না। তুমি সকল ক্ষেত্রে থেকে আমার রিযিকদাতা। হে পরোয়ারদিগার! ফাতিমাকে এমন সব কিছু দাও যা চক্ষু কখনো অবলোকন করে নি আর কোনো কর্ণ কখনো শ্রবণ করে নি।”

প্রিয় নবী তার দোয়ার শেষে 'আমিন' বললেন এবং তাঁর সাহাবীদের প্রতি তাকিয়ে বলেন : “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এ পৃথিবীতে ফাতিমাকে এই দোয়ার ফল দান করেছেন। কেননা আমি তাঁর পিতা, আমার সমকক্ষ পৃথিবীতে অন্য কেউ নেই। আর আলী তাঁর স্বামী। যদি আলী না থাকতো তাহলে কখনো তাঁর সমকক্ষ স্বামী খুঁজে পাওয়া যেত না। আল্লাহ ফাতিমাকে হাসান ও হুসাইনকে দান করেছেন। বিশ্বের বুকে মানবকুলের মাঝে তাদের ন্যায় আর কেউ নেই। কেননা তাঁরা বেহেশতের যুবকদের সর্দার।”

এদিকে, হযরত আম্মার গলার হারটি নিয়ে মেশক দ্বারা সুগন্ধযুক্ত করলেন এবং ওটাকে ইয়েমেনি কাপড়ে মোড়ালেন। তার একজন দাস ছিল। তার নাম ছিল সাহম। খায়বরের যুদ্ধের গণিমতের মালের যে অংশ তাঁর ভাগে পড়েছিল তা দিয়ে তিনি এই গোলামকে ক্রয় করেছিলেন। তিনি গলার হারটিকে তাঁর এ গোলামের হাতে দিয়ে বললেন: এটা রাসূল (সা.)-কে দিও আর তুমিও এখন থেকে তাঁর হয়ে গেলে।

গোলাম গলার হারটি নিয়ে রাসূল (সা.) খেদমতে পৌঁছে আম্মারের বক্তব্য তাঁর কাছে বলল। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) বললেন: তুমি ফাতিমার কাছে চলে যাও। তাকে গলার হারটি দিয়ে দাও আর তুমিও এখন থেকে তাঁর হয়ে কাজ করবে।

লোকটি হযরত ফাতিমার কাছে গলার হারটি নিয়ে গেল এবং নবী (সা.)-এর কথা তাঁর কাছে পৌঁছাল। হযরত ফাতিমা গলার হারটি গ্রহণ করলেন আর দাসটিকে মুক্ত করে দিলেন। দাসটি হাসি ধরে রাখতে পারলো না। হযরত ফাতিমা প্রশ্ন করলেন : “তোমার হাসির কারণ কি?”

সদ্য মুক্ত দাসটি বলল: “এই গলার হারের অভাবনীয় বরকত আমার মুখে হাসি ফোটাতে বাধ্য করেছে। যা ক্ষুধার্তকে অন্ন দিয়ে পেট ভর্তি করেছে, বস্ত্রহীন ব্যক্তিকে বস্ত্র পরিধান করিয়েছে এবং অভাবীর অভাব পূরণ করেছে আর একজন দাসকে শৃঙ্খলমুক্ত করেছে। অবশেষে গলার হার আবার তার মালিকের কাছে ফিরে এসেছে।”

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি নাতে রাসূল। 'হে রাসূল বুঝি না আমি' শিরোনামের নাতটির  কথা ও সুরঃ তোফাজ্জল হোসেন খানের। আর গেয়েছে শিশুশিল্পী জাইমা নূর। 

জাইমার দরদী কণ্ঠে গানটি শুনলে। তো বন্ধুরা, তোমরা যারা রংধনু আসরে অংশ নিয়ে গান, কবিতা, সুরা কিংবা কৌতুক শোনাতে চাও তারা আমাদের কাছে ইমেইল করে তোমাদের মোবাইল বা টেলিফোন নম্বর জানাও। আমরাই তোমাদেরকে ফোন করে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করব।

আমাদের কাছে ইমেইল করার ঠিকানা: [email protected]

তো বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে বিদায় নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর থেকে। কথা হবে আবারো আগামী সপ্তাহে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৫

ট্যাগ