নভেম্বর ০৮, ২০২৩ ১৬:২২ Asia/Dhaka

গত আসরে দুই আসরে আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইরানি কমান্ডার শহীদ মোহাম্মাদ ইব্রাহিম হেম্মাতের অবদান নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই যুদ্ধে হেম্মাতের নেতৃত্বাধীন ‘২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ ব্রিগেডের ভূমিকা নিয়ে আরো কিছু কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

বায়তুল মুকাদ্দাস নামক সফল অভিযানের মাধ্যমে খোররামশাহর মুক্ত করার পর ২৭ ব্রিগেডকে সিরিয়ায় পাঠানো হয়। কারণ, ওই সময় ইহুদিবাদী ইসরাইল লেবাননে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল এবং বেশিরভাগ মুসলিম দেশ এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছিল।  কাজেই ইরানের পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা লেবাননকে ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৭ ব্রিগেডের প্রায় ৫০০ সেনাকে দামেস্কে পাঠান। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) বিষয়টি জানতে পেরে সেনা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করতেন, লেবাননকে ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর চেয়ে ইরানকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ সম্পর্কে এক ভাষণে বলেন, ইরাকি বাহিনীকে অবহেলা করলে তারা গোটা ইরান দখল করে নিতে পারে।

ইমামের নির্দেশে সিরিয়া থেকে ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্রিগেডকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে লেবাননের গণবাহিনীকে সংগঠিত করার কাজে সহযোগিতা করার জন্য ব্রিগেডের কমান্ডার আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ান এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তা সিরিয়ায় থেকে যান। কিন্তু মুতাওয়াসসেলিয়ান দামেস্ক থেকে সড়কপথে বৈরুত যাওয়ার পথে ইসরাইল সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী ফ্যালাঞ্জিস্টদের হাতে অপহৃত হন। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আহমাদ মুতাওয়াসসেলিয়ানের অনুপস্থিতিতে ইব্রাহিম হেম্মাত ২৭ ব্রিগেডের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। সে সময় ইরান ইরাকের বিরুদ্ধে ‘তৃতীয় রমজান’ অভিযান পরিচালনা করছিল। ইরানি যোদ্ধারা খুজিস্তানের সঙ্গে ইরাকের সীমান্তবর্তী ‘জেইদ’ এলাকায় আগ্রাসী ইরাকি সেনাদের বহু ট্যাংক ধ্বংস এবং আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই অভিযানে ২৭ ব্রিগেড গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।  ওই অভিযানের পর ২৭ ব্রিগেডকে ডিভিশনে উন্নীত করে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে পাঠানো হয়।

সেখানে ‘সুমার’ নামক এলাকায় এই ডিভিশন ‘মুসলিম বিন আকিল’ অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে ২৭ মোহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ডিভিশন আগ্রাসী বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে ইরাকের মান্দালি শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই অভিযান সাফল্যের সঙ্গে শেষ করার পর ২৭ ডিভিশনকে ইরাকের সঙ্গে ইরানের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী ‘ফাকে’ এলাকায় পাঠানো হয়।  ‘জাযাবে’ উপত্যকা থেকে ফাকে এলাকা পর্যন্ত শত্রুসেনাদের অবস্থান ধ্বংস করাকে এই অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ২৭ ডিভিশনকে ইরাকি বাহিনীর পেতে রাখা অসংখ্য মাইন এবং সামরিক ফাঁদ ধ্বংস করে সামনে এগিয়ে যেতে হতো।  ‘প্রাথমিক ওয়ালফাজর’ নামক এই অভিযানে শহীদ ইব্রাহিম হেম্মাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দুঃখজনকভাবে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বনি সদর এই অভিযানের তথ্য আগেভাগে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে জানিয়ে দেয়ার কারণে অভিযানটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তবে সে সময় বনি সদরের এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানা যায়নি। অভিযানটি ব্যর্থ হওয়ার ২২ বছর পর ২০০৩ সালে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পতনের ফলে বাগদাদ থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন নথি থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য ইরানের হাতে আসে। এতে দেখা যায়, বনি সদর অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ১৯৮৩ সালের শীতকালে প্রাথমিক ওয়ালফাজর অভিযানের তথ্য বুলগেরিয়াস্থ ইরাক দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। বনি সদর পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আরো কিছু কাজ করে পদচ্যুত হন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগেই তিনি ছদ্মবেশে দেশ ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন। ইরানের সাবেক এই বিশ্বাসঘাতক প্রেসিডেন্ট প্যারিসে বসবাস করতেন এবং ২০২১ সালের অক্টোবরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

ইরাকের গোপন দলিল থেকে একথাও জানা যায় যে, বনি সদর ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির মুনাকো শহরের একটি ব্যাংকে ছয় দফায় তার জন্য টাকা পাঠায় সাদ্দাম সরকার। এই টাকা ছিল দেশের সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার।  যাই হোক, ইরানি যোদ্ধার অভিযান শুরু করার আগেই এর পরিকল্পনা বাগদাদ জেনে যাওয়ায় ইরাকি বাহিনী অভিযানের রুটগুলোতে ইরানি যোদ্ধাদের অপেক্ষায় থাকে।  ফলে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলের ১২০ সদস্যের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই শহীদ হয়ে যান। তবে শাহাদাতের আগে এই যোদ্ধারা পাঁচ দিন পর্যন্ত জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম লড়াই চালিয়ে যান। এখানে ইরাকি বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে শহীদ কমান্ডার মাহমুদ সাবেতনিয়া ও শহীদ আলীরেজা বাংদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

এভাবে ইরাকি বাহিনীর হাতে অসহায়ভাবে শহীদ হয়ে যাওয়ার আগে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ইরানি যোদ্ধাদের সর্বশেষ যে কথাগুলো কমান্ডার হেম্মাত শুনতে পান তা হলো- “আমাদের এখানে পানি নেই, খাবার নেই, সব গোলাবারুদ শেষ, ইরাকি ট্যাংক আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আর হয়তো কথা হবে না। ইমামকে আমাদের সালাম পৌঁছে দেবেন। ”

২৭ ডিভিশনের গোয়েন্দা প্রধান ওই মুহূর্তের কথোপকথনের ঘটনা বর্ণনা করেন এভাবে: “ওয়ারলেসের ওই প্রান্ত থেকে ইব্রাহিম হেম্মাতকে বলা হয়: স্যার, ইমামকে আমাদের সালাম পৌঁছে দেবেন এবং তাকে বলবেন আমরা তার নির্দেশ মতো ইমাম হোসেইনের মতো লড়াই করে ইমাম হোসেইনের মতো শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে যাচ্ছি।  একথা বলার পর তার সঙ্গে শহীদ হেম্মাতের বেতার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  হেম্মাত কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে তাকিয়ে থাকেন এবং এর পর মুহূর্তে ঘাঁটি থেকে দ্রুত বের হয়ে যান। আমরা তাকে অনুসরণ করি। দেখি তিনি সূর্যাস্তের মুহূর্তে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন এবং চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছেন।”

ওয়ারলেসে অপর প্রান্তে ৩৯ বছর বয়স্ক যে যোদ্ধা জীবনের শেষ মুহূর্তের কথাগুলো বলছিলেন যুদ্ধ শেষে তার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণকারী দলের এক সদস্য এ সম্পর্কে বলেন: আমরা অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে একজন শহীদের দেহাবশেষ দেখতে পাই যার পাশে একটি ডায়েরি পড়েছিল। এত বছর পরও ডায়েরির লেখাগুলো পড়া যাচ্ছিল। সেখানে জীবনের শেষ মুহূর্তের কষ্টের কথাগুলো লেখা ছিল। তিনিসহ অন্য শহীদদের দেহাবশেষের অবস্থা দেখা প্রতীয়মান হয় যে, তাদেরকে হত্যা করার পর তাদের দেহের উপর দিয়ে ইরাকি বাহিনী ট্যাংক চালিয়ে দিয়েছিল। ফলে তাদের পাঁজরের এক পাশের হাঁড় আরেক পাশে ঢুকে গিয়েছিল। ইরানি যোদ্ধারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে অকুতোভয় যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন এবং তারা কোনো অবস্থাতেই ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দি হতে রাজি হননি।  

তো শ্রোতাবন্ধুরা, দেখতে দেখতে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল। #

পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ