নভেম্বর ১০, ২০২৩ ২১:৫৮ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। খুব শিগগিরি তফসিল ঘোষণা হতে যাচ্ছে। এরমধ্যে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকে যদি পেশিশক্তি, প্রশাসনিক শক্তি,পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে কিছুই বলার থাকে না। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্মা ও সাংবাদিক আবু রুশদ।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দেশের সবচেয়ে  ঐতিহ্যবাহী দল যদি আওয়ামী লীগ যদি এই সময়ে এসে জনগণের পালস না বুঝতে পারেন তাহলে তা দেশের জন্য ভালো হবে না।

  • বিশিষ্ট এই সংবাদিক বলেন, সরকার আসলে একরোখা মনোভাব নিয়ে যদি বলে আমরা ছাড়া আর কেউ থাকবে না, তাহলে তো কিছু বলার নেই! বিরোধী দল যদি না থাকে, বিএনপিকে যদি আপনারা ধ্বংস করে দেন; তাদের কোটি কোটি সমর্থককে যদি মেরেও ফেলেন-তারপর কী হবে! এটা কি তারা চিন্তা করে! তাহলে আওয়ামী লীগ থাকারই বা দরকার কী? উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দল বানিয়ে শাসন করলেই হয়! একটি একনায়কতান্ত্রিক শাসন হলেই তো হয়।
  • '২০১৪ কিংবা ১৮ সালের মতো নির্বাচন হলে বাংলাদেশ বড় নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে।'

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, আবু রুশদ, বাংলাদেশে বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভাষায় গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন করছে। তারা বলছে- বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আন্দোলনের যে গতি-প্রকৃতি তাতে কী আপনার মনে হয় এই লক্ষ্য অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে?

২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ

আবু রুশদ: দেখুন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বিএনপি ও এর জোটভুক্ত সমমনা দলগুলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন বলতে যা বুঝে থাকি সেভাবে তারা করতে পারছে না। কিন্তু আপনি গত কয়েক মাস লক্ষ্য করে থাকবেন বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি যে জনসমাবেশ বা মিটিং মিছিল করেছে সেগুলোতে সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। আর সরকার তাদের জনসমাবেশের সময় বাস, লঞ্চ বন্ধ করেও কিন্তু জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারেনি। আর যদি পেশিশক্তির কথা বলেন সেক্ষেত্রে হ্যাঁ পেশিশক্তি, প্রশাসনিক শক্তি তারপর গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তার বিষয়টি ধরেন তাহলে তো সাধারণ মানুষের আর করার কিছুই থাকে না!

সতর্ক অবস্থায় পুলিশ

বিরোধীদল বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলোর যে দাবি সেসব দাবির প্রতি সাধারণ মানুষ কিন্তু সমর্থন দিচ্ছে।  আমি তো ঢাকায় থাকি। সম্প্রতি ২৯ অক্টোবর ঢাকাসহ সারাদেশে যে হরতাল হলো- সেটি অবিশ্বাস্য। আমার এত দিনকার সাংবাদিকতা জীবনে এমনটি দেখিনি যে পিকেটিং ছাড়াই এভাবে একটি হরতাল হতে। মানুষেরা নিজেরাই পার্টিসিপেট করেছে। রিকশাওয়ালারা নিজেরাই বলেছে যে, তারা একটা পরিবর্তন চায়। তাদের যদি আয় রোজগার কমও হয় তবুও তারা হরতালের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। এই জিনিষটি হচ্ছে নৈতিক অবস্থান থেকে। এটি খুবই বড় একটি বিষয়।

আর আপনি যদি বলেন, যে আমি মেরে কেটে, পেশিশক্তির বলে সমস্ত পুলিশ বাহিনী , প্রশাসন ব্যবহার করে, গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে ক্ষমতায় থাকব কিংবা আন্দোলন দমন করব তাহলে সাধারণ মানুষ যারা রাজনীতি করেন কিংবা রাজনৈতিক নেতা কর্মীদেরও কিছু করার থাকে না। এরকম ঘটনা বহু একনায়কতান্ত্রিক দেশে ঘটেছে। এখন যদি কেউ মনে করে যে বাংলাদেশ একনায়কতান্ত্রিক একটি দেশের দিকে যাবে এবং শক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে সবকিছু করব সেক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন আন্দোলনকারীরা রাজপথে দাঁড়াতে পারছে না। তবে প্রশ্ন উঠবে কিসের ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারছে না!

২৮ অক্টোবর বিএনপি অফিসের সামনে

গত ২৮ অক্টোবরে বিএনপির মহাসমাবেশে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে সরকারি দলের পক্ষ থেকে, পুলিশসহ অন্যান্যদের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ মানুষ কি করতে পারে! কিন্তু যদি আপনি নৈতিক অবস্থান এবং মানুষের সমর্থনের দিক থেকে বিবেচনা করেন তাহলে আমি বলব যে, বিএনপি কোনো সহিংসতার মধ্যে না গিয়ে বাংলাদেশে একটি জনজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছে। এটি অন্যান্য বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

রেডিও তেহরান: বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার দিকে এগিয়ে চলেছে। নির্বাচনের তোড়জোড় পুরো মাত্রায় চলছে। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হলে এবং তাতে যদি বিএনপি যোগ না দেয় তাহলে নির্বাচন কী গ্রহণযোগ্যতা পাবে?

আবু রুশদ: দেখুন, এবার এই নির্বাচন অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচন এভাবে হলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার কোনোই প্রশ্ন ওঠে না। আগেই তো বললাম- প্রশাসন, গোয়েন্দাবাহিনী, আমলাদের জোর দিয়ে গ্রহণযোগ্য করা যাবে এমনটি অনেক দেশ করেছে কিন্তু তা করে কি লাভ হবে! ধরুন এ দেশে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ৩৫ ভাগ বাকি লোকগুলো কাদের? গত ১৪ বছরের মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি মানুষ সুষ্ঠু হতে দেখেছে। এরপর ২০১৪ এবং ২০২১৮ সালের নির্বাচন মানুষ দেখেছে! এরপরও কীভাবে এবার গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে আগেও আমি বলেছি-অস্ত্রশক্তির বলে, পেশিশক্তির বলে, প্রশাসনিক শক্তির বলে আপনি বলতেই পারেন যে আমি ক্ষমতায় থাকব। আমরা নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করব। তবে সেই নির্বাচন আবারও একটি হাস্যকর নির্বাচন হবে! বাংলাদেশে তো বটেই  আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও । সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এইসব দেখতে দেখতে মানুষ ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেছে। সেই ২০১৪ সাল, ২০১৮ সাল একই কৌশল! এভাবে কতদিন ! সবকিছুর তো একটা লিমিট আছে। সেই লিমিট ছাড়িয়ে কতদিন এভাবে করতে থাকবেন!

শ্রোতাবন্ধুরা! বাংলাদেশের উত্তপ্ত ও সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আবু রুশদের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব আবু রুশদ,  ২০১৪ বা ২০১৮ সালে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে অভিযোগ আছে কিন্তু তা তো মেনে নিয়েছে বিদেশিরা। এবারো কী তেমনটা হতে পারে? সেটা হলে বিএনপি বা বিরোধীদের কী করার থাকবে?

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ভবন

আবু রুশদ: দেখুন, ২০১৪ সালের যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেখানে ১৫১ কি ১৫২ টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। উপমহাদেশে এমন নির্বাচনের কথা চিন্তাও করা যায়। আর সেই নির্বাচনকে প্রথম সমর্থন জানিয়ে স্বাগত জানিয়েছে কে? সেটি হচ্ছে প্রথমে ভারত! তারপর চীন! পশ্চিমা কোনো শক্তি কিংবা গণতান্ত্রিক শক্তি কিন্তু স্বাগত জানায়নি।

২০১৮ সালের নির্বাচনেও কিন্তু তারা কেউ সমর্থন জানায়নি। সেখানে চীনের রাষ্ট্রদূত একটি স্বর্ণের নৌকা নিয়ে এগিয়ে এসে সমর্থন জানাল ও স্বাগত জানাল। এবার যদি একইভাবে নির্বাচন হয় সেটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এখনকার পরিস্থিতি ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের পরিস্থিতির চেয়ে অন্যরকম। এখন বাংলাদেশের বিরোধী অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলো এক হয়েছে, তারা বারবার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে। এর অবশ্যই বহুমুখী উদ্দেশ্য আছে। যদি আবারও ঐ একইরকম নির্বাচন হয় তাহলে আমরা হয়তো বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ব। আমাদের বিশাল কোনো খনিজ সম্পদ নেই একমাত্র গার্মেন্টস আর রেমিটেন্স ছাড়া আমাদের পক্ষে টেকা সম্ভব না। মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপ থেকে প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স আসে। তা কমে গেলে আমরা কি করব!

রেডিও তেহরান: আমেরিকা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে যা সরকারের জন্য ঝামেলার কারণ কিন্তু সরকার সেগুলো তেমন কোনো আমলে নেয়নি। এ থেকে আওয়ামী লীগের জন্য কী ধরনের সুবিধা বা অসুবিধা হতে পারে?

আবু রুশদ: দেখুন, আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল। আর রাজনীতি কী? রাজনীতি মানুষের জন্য। তা নাহলে তো আমলা দিয়েই দেশ চলতে পারত এমপিদের দরকার হতো না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সবচেয়ে পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা যদি জনগণের পালস না বোঝে, নাড়ির গতি টের না পেয়ে যদি এভাবে একরোখাভাবে চলতে থাকে তাহলে শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া তারা কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেবে। এসব দেশ কিন্তু বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের গার্মেন্টস পণ্য নিয়ে, বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। তারা যদি সরে যায় তাহলে কি আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে। দেশের জন্য কি ভালো হবে!

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

দেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের কোনো মূল্য নেই। তারা খেয়ে থাকল  নাকি না খেয়ে থাকল , নাকি জেলে থাকল তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই তাদের। তাদের ভাবনা আমরা ছাড়া সবাই জেলে থাকবে! কিন্তু তারপর কী হবে! আমাদের সক্ষমতা কোথায়? যে ভিত্তিগুলোর ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেগুলোকে আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি। আসলে একরোখা মনোভাব নিয়ে যদি বলা হয় আমরা ছাড়া আর কেউ থাকবে না, তাহলে তো কিছু বলার নেই! বিরোধী দল যদি না থাকে, বিএনপিকে যদি আপনারা ধ্বংস করে দেন; তাদের কোটি কোটি সমর্থককে যদি মেরেও ফেলেন-তারপর কী হবে! এটা কি তারা চিন্তা করে! তাহলে আওয়ামী লীগ থাকার দরকার কী? উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দল বানিয়ে শাসন করলেই হয়!

রেডিও তেহরান: তো জনাব আবু রুশদ আলাপন অনুষ্ঠানে আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আবু রুশদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/জিএআর/১০

 

ট্যাগ