নভেম্বর ২০, ২০২৩ ১৭:২৯ Asia/Dhaka

একমাসের বেশি হয়ে গেল গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত-আকাশ থেকে এবং স্থলভাবে। যুদ্ধ বন্ধে আজও তেমন কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কেবল কিছু আলাপ আলোচনা হচ্ছে মাত্র। নারী-শিশুসহ হাজারে হাজারে ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন-শহীদ হয়েছেন। তো গাজা যুদ্ধ নিয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন লেখক, গবেষক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ মাওলানা নাজমুল হুদা।

তিনি বলেছেন, ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে হামাস বিজয়ী হয়েছে তিন কারণে। তাদের আক্রমণ সম্পর্কে মোসাদ বিন্দুমাত্র কিছু জানতে পারেনি। অত্যাধুনিক ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছিল ২৪ ঘন্টার মধ্যে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। একমাসেরও বেশি হয়ে গেল হামাস যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ হামাসের না আছে ট্যাঙ্কবহর না আছে বিমানশক্তি। আরও একটি আত্মিক শক্তি ও চেতনাবোধের জায়গা মুসলমানরা পেয়েছে হামাসের কাছ থেকে। সেটি হচ্ছে হামাসের মতো একটি শক্তির কাছে যখন অপরাজেয় ইসরাইলি বাহিনীর নাস্তানাবুদ অবস্থা তাহলে সমস্ত মুসলিম শক্তিগুলো যদি এক হয় তাহলে তাদের বিজয় সম্ভব। চেতনাবোধের এই জায়গাটা দিয়েছে হামাস।

বিশিষ্ট এই গবেষক বলেন, তবে বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব। আত্মিক শক্তির অভাব। তারা কেবল গদিরক্ষার চিন্তা করে মুসলিম জাতিসত্তা রক্ষায় তাদের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো

এটি উপস্থাপনা ও গ্রন্থনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, মাওলানা নাজমুল হুদা, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত এক মাসের বেশি সময় ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসন চলছে। কিন্তু ইরান বাদে প্রায় বলতে গেলে পুরো বিশ্ব নীরব। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

মাওলানা নাজমুল হুদা: বর্তমানে মুসলিম জাতিসত্তার পক্ষে ইরানের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ইরান সবসময়ই মুসলিম জাতির স্বার্থরক্ষায় তৎপর। দেখুন, গাজা ইস্যুতে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের যে নীরবতা সেটি অকল্পনীয় ব্যাপার। তবে একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, ইসরাইলের প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং সর্বাধিুনিক অস্ত্রসম্ভার অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইসরাইল একসময় মুসলিম বিশ্বের ওপর দিয়ে যুদ্ধ বিমান উড়িয়ে নিয়ে ইরাকে গবেষণাগারের ওপর বোমা বর্ষণ করেছিল। এটি খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। অথচ তার কোনো প্রতিবাদ কিংবা প্রতিকার কোনো কিছুই করতে পারেনি কোনো রাষ্ট্র।

বর্তমান বিশ্বে ইরান চলমান পরিস্থিতিরি সাথে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং আবিস্কারের ব্যাপারে ইরান অনকেটা অগ্রগামী। এ কারণে ইসরাইল অনেকবার ইরানকে হুমকি দিয়েও তার ওপর কোনো সামরিক অভিযান চালাতে সাহস পায়নি। এটি ইরানের একটি  বিশাল বিজয়। বর্তমানে ইরানের পাশে ন্যুনতম হলেও তুরস্ক কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। যদি অন্য মুসলিম দেশগুলোও যদি ইরান ও তুরস্কের সাথে সোচ্চার হতো তাহলে হয়তো বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্নদিকে যেত বলে মনে করা যায়।

রেডিও তেহরান:  বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নীরবতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মাওলানা নাজমুল হুদা: মুসলিম বিশ্বের নীরবতা বিপজ্জনক হতে পারে। এ প্রসঙ্গে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে নিয়ে আমি বলব- তাদের মধ্যেকার সবচেয়ে বড় ক্রটি হচ্ছে আদর্শিক চেতনার অভাব। যে আদর্শিক চেতনা একটা সময় পৃথিবীতে মুসলিম জাতিকে উচ্চকিত করেছিল বর্তমানে সেই আদর্শিক চেতনার অবনমন ঘটেছে। এমনকি মুসলিম বিশ্বের অনেকে দেশে ওয়েস্টার্ন কালচার এমনভাবে জেকে বসেছে যে তারা  ইসলামিক উন্নত কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভুলতেই বসেছে। মূলত আত্মিক শক্তি পেশি শক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এমনকি অস্ত্র শক্তির চেয়েও  আত্মিক শক্তি-শক্তিশালী। যে আত্মিক শক্তি মুসলিম বিশ্বের ছিল বর্তমানে সেই আত্মিক শক্তি থেকে বিতাড়িত প্রায়। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে ইহুদি জাতি তাদের ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সেই তুলনায় মুসলমানদের চেতনা বিশেষ করে চেতনাগত ঐক্যের দিকে অগ্রসর হতে পারছে না। তাহলে বর্তমানে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ না, আত্মিক দিক থেকে দুর্বল এবং চরিত্রগত  দিক থেকেও দুবলতা তো আছেই। সার্বিক বিবেচনায় আমি বলব, মুসলিম সরকারগুলো শুধুমাত্র গদি রক্ষার জন্যই বর্তমানে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চূপ। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র নেই। আর এ কারণে সেখানে জনগণের মনোভাব প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। শাসকগোষ্ঠী অক্টোপাশের মতো চেপে বসে আছে। গদির লোভে, ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে তারা সচেষ্ট। তারা জাতিসত্তার বিষয়ে ততোটা আগ্রহী না। তারা পশ্চিমা বিশ্বের পদলেহন করে তাদের কৃপা ভিক্ষা করে কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে সেই চিন্তায় তারা ব্যস্ত।

ভয়াবহ গাজা যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে মাওলানা নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। মাওলানা নাজমুল হুদা, ওআইসি গঠনের একটা বড় লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা, মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু ৫৭ জাতির এই সংস্থা নিদারুনভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

মাওলানা নাজমুল হুদা: দেখুন, পৃতিবীতে বহু জোট গঠিত হয়েছে। যেমন ন্যাটো এবং ওয়ারশ জোট। তারা খুবই শক্তিশালী জোট ছিল। ওয়ারশ কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিম জাতিসত্তার জন্য ওয়াইসি গঠন করা হয়েছিল। এটা ছিল খুবই ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার। মুসলিম জাতিসত্তা এবং স্বার্থরক্ষার জন্য এই জোট ভূমিকা পালন করবে এটাই ছিল কাম্য। কিন্তু সেই ভূমিকা পালনের জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে একতা এবং সামরিক শক্তির উৎকর্ষতা। যেমন ন্যাটো-সেটি সম্মিলিত সামরিক জোট। অথচ মুসলিম বিশ্বের জোট ওয়াইসির সামরিক জোট করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই রাখেনি। সামরিক শক্তি না থাকলে জোটের দ্বারা কীভাবে জাতিসত্তার মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব! আত্মরক্ষার কৌশল কীভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটাও আমার বুঝে আসে না। তারা মাঝে মাঝে কিছু মিটিং এ বসে কিছু আলাপ আলোচনা করে আর কিছু বিবৃত্তি দেয়ার মধ্যেই বর্তমান ওয়াইসি তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। বর্তমানের মতো নাজুক পরিস্থিতিতেও মুসলিম বিশ্বের সামরিক জোট গঠনের চিন্তা-প্রচেষ্টা কোনোটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। গতি যদি না থাকে তাহলে সে পথ হারাবে। যে নদীর গতি থাকবে না সে নদীর মৃত্যু হবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। ওয়াইসি গতিহীন একটা সংস্থা। সুতরাং ওয়াইসি দিয়ে তাদের নীতি আদর্শ দিয়ে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত দুরূহ।  

রেডিও তেহরান: সবশেষে মাওলানা নাজমুল হুদা আপনার কাছে জানতে চাইছি,  এবারের গাজা যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে আপনি আশা করেন?

মাওলানা নাজমুল হুদা: দেখুন, এবারের গাজা যুদ্ধ এর আগের ইসরাইল ফিলিস্তিন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের  যুদ্ধগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম এইজন্য যে, একসময় মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান সম্মিলিতভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তারা সফলতা পায়নি। একমাত্র হামাস তাদের চেয়েও অনেক শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ তাদের কোনো বিমানবাহিনী নেই, কোনো ট্যাঙ্ক বহর নেই। তারপরও হামাস যুদ্ধে যে সফলতা দেখিয়েছে তা সত্যিই অবিস্মরণীয় ব্যাপার। আসলে হামাসের যে আত্মিক শক্তি আছে সেই আত্মিক শক্তি মুসলিম বিশ্বের আর কোনো সেনাবাহিনীর ভেতর নেই। এটি বর্তমান গাজা যুদ্ধে প্রমাণিত। এই যুদ্ধে হামাস তিন পর্বে বিজয় লাভ করেছে।

প্রথমত: মোসাদকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কেবল আমরাই না পৃথিবীর মানুষ জানত। কিন্তু সেই মোসাদ হামাসের আক্রমণের পরিকল্পনা বা এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য বিন্দুমাত্র জানতে পারেনি। এটি মোসাদের ব্যর্থতা আর হামাসের সফলতা।

দ্বিতীয়ত: এই যুদ্ধে অতি অল্প সময়ে হামাস  যে বিজয় অর্জন করেছে সেটি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বকে ভূমিতে মিশিয়ে দিয়েছে। বলা হতো ইসরাইলি সেনাবাহিনী অপরাজেয়। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই এমন ধারণা মানুষের মধ্যে বিরাজ করত। হামাস সেই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে।

তৃতীয়ত: হামাসকে ধ্বংস করার জন্য ইসরাইলের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছে। প্রায় তিনলক্ষ সেনা মোতায়েন করেছে। তারা শুরুর দিকে বলেছিল ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এলাকা ছাড়তে এবং হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। অথচ এক মাসের বেশি হয়ে গেল এখনও হামাস যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আগামীতে কি হবে তা আল্লাহ পাকই জানেন। তবে সীমিত পরিসরে হামাসের আত্মরক্ষামূলক যে যুদ্ধ প্রতিরক্ষামূলক যে যুদ্ধ তা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আর এই তিন পর্যায়ে হামাস বিজয়ী হয়েছে।

চতুর্থ: হামাসের একার পক্ষে যদি ইসরাইলকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি থেকে থাকে তাহলে আমরা ইচ্ছে করলেই সম্মিলিতবাবে অনেক কিছুই করতে এই চেতনাবোধ অন্তত জাগ্রত হবে এ বিশ্বাস আমার আছে।

তো জনাব মাওলানা নাজমুল হুদা, চলমান গাজা যুদ্ধ নিয়ে রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।

মাওলানা নাজমুল হুদা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২০

ট্যাগ