নভেম্বর ২০, ২০২৩ ২০:৪৪ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হোর অঞ্চলে পরিচালিত খায়বার অভিযান এবং এতে ইরানের কয়েকজন সেনা কমান্ডারের শাহাদাত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের বিজয়ে ঈমানি শক্তির ভূমিকা নিয়ে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই যুদ্ধ লেগেছে তা সেখানে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া আর কিছু বয়ে আনেনি। তবে ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া আরো একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন চোখে পড়ে। আর তা হচ্ছে, ইরানি যোদ্ধাদের মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ। ইরানি যোদ্ধারা পারতপক্ষে কোনো বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতেন না কিংবা কোনো বেসামরিক শহরে হামলা চালালে আগেই ঘোষণা করে দিতেন অমুক শহরের বেসামরিক নাগরিকরা যেন অমুক সময়ের মধ্যে শহর ছেড়ে চলে যায়। এই ঘোষণা এ কারণে দেয়া হতো যে, যাতে সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে চলে যেতে পারে এবং যুদ্ধের ক্রসফায়ারে পড়ে মারা না যায়। এছাড়া ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ করতেন।  পক্ষান্তরে ইরাকি সেনারা ইরানি যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে চরম অমানবিক আচরণ করাকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করেছিল।

ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে এই মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল ইসলামের সুমহান শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে ছিল আল্লাহ তায়ালা এবং তার প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি দৃঢ় ঈমান। ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটি বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান তাদেরকে শত্রুর মোকাবিলায় অসম যুদ্ধে শক্তি ও সাহস যোগাবে এবং বিজয় এনে দেবে। সমরাস্ত্র ও প্রশিক্ষণ উভয় দিক দিয়ে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর তুলনায় পিছিয়ে ছিল ইরান। কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভরতার কারণে তারা ওই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।  এ সম্পর্কে ইরানের সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ সাইয়্যাদ শিরাজি বলেন: ইরানের সেনাবাহিনী আজ ইসলামের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে এবং তারা ঈমানি অস্ত্রে সুসজ্জিত। বিশ্বের খুব কম সেনাবাহিনীর মধ্যে এই গুণ পাওয়া যায়।

ইরানি যোদ্ধারা মহান আল্লাহর প্রতি ঈমানকে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর অস্ত্র বলে মনে করতেন। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস ছিল যে, ইরাকি বাহিনী সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ইরানি যোদ্ধাদের মোকাবিলায় তারা পেরে উঠছিল না; কারণ, আল্লাহর প্রতি ঈমান হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল।

ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকার ইরানে আগ্রাসন চালানোর কিছুদিনের মধ্যেই একথা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, কয়েকদিনের জন্য খুজিস্তান প্রদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কিংবা কিছুদিনের মধ্যে তেহরানে পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।  তারা একথা বুঝতে পারে যে, তাদের সামনে অনেক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।  

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের বিজয়কে ঈমানি শক্তির বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি ইরানি যোদ্ধাদের উদ্দেশ করে বলতেন: আপনারা ঈমানি ও ইসলামি শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এসব বিজয় অর্জন করছেন। মুসলিম বাহিনীর ঈমানি শক্তির বিজয়ের দিক দিয়ে তিনি পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের যুদ্ধগুলোর সঙ্গে তুলনা করতেন। ইরানি যোদ্ধারা ইরাক সীমান্তবর্তী নৌসুদ শহর পুনরুদ্ধার এবং মুশাররাফ টিলা দখল করার পর ইরানের সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ শহীদ জেনারেল ফাল্লাহিকে লেখা এক বার্তায় ইমাম বলেন:

“আধিপত্যকামী ও পরাশক্তিগুলো ইরাকের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে তার মোকাবিলায় এই বিজয়গুলো কুফরি শক্তির বিরুদ্ধে ইসলাম ও ঈমানি শক্তির বিজয়। এই বিজয় তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে মানবীয় মূল্যবোধগুলোর বিজয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুমিন মুসলমান যোদ্ধারা সামান্য অস্ত্রসস্ত্র ও রসদ নিয়ে যুদ্ধে গেলেও তাদের ঈমানি শক্তি ও প্রতিশ্রুতির পারদ ছিল তুঙ্গে। এ কারণেই তারা সব ধরনের অস্ত্রে সুসজ্জিত কাফির ও শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী হতেন। সেসব যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যাও ছিল কাফির বাহিনীর তুলনায় অতি নগণ্য।” এই মূল্যবান বিশ্বাসকে ধারন করে ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরানি যোদ্ধাদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন: আপনাদের অন্তরে যতক্ষণ ঈমানি শক্তি প্রবল থাকবে ততক্ষণ আপনাদের বিজয় সুনিশ্চিত। আপনার চেষ্টা থাকবে এই শক্তিকে অন্তরে প্রবল থেকে প্রবলতর করার।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীও আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের বিজয়কে ঈমানি শক্তির বিজয় বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, অনেকেই প্রশ্ন করেন, আমাদের পক্ষে এত বড় বড় বিজয় অর্জন কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? এর উত্তর একটিই। ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার ছায়াতলে এসব বিজয় অর্জিত হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে সমরাস্ত্রসহ অন্যান্য সাজ সরঞ্জাম অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সেগুলো বিজয় নিশ্চিত করতে পারে না। এই সমরাস্ত্র যারা পরিচালনা করছে তারা ঈমানি শক্তির বলে বলীয়ান কিনা সেটি হচ্ছে আসল বিষয়।

ইরানের সেনাবাহিনী এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির কমান্ডাররা বিভিন্ন অভিযানে তাদের বিজয়ে ঈমানি শক্তির এই মাহাত্ম্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। আইআরজিসির সাবেক কমান্ডার মেজর জেনারেল সাফাভি পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি খায়বার অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

মাজনুন দ্বীপ দখলের অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে কুফর, প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে ঈমানি শক্তি বিজয় লাভ করে। বাস্তান শহর পুনরুদ্ধারের পর ইরানের অন্যতম সেনা কমান্ডার জেনারেল জহিরনেজাদ বলেন, ইরানি যোদ্ধাদের বিজয়ের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ঈমান। ইরাকি সেনা কমান্ডাররাও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তাদের কাছে পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে পাওয়া সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র থাকার পরও ঈমানি শক্তির ঘাটতি থাকার কারণে তারা ইরানের কাছে পরাজিত হয়েছেন। ইরানের হাতে আটক একজন ইরানি সেনা কমান্ডার বলেন, আবাদানে আমরা নিজেদের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেছিলাম। কিন্তু ইরানিরা সেটি পুনরুদ্ধার করার পর আমাদের সবার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আমাদের পক্ষে আর ইরানি ভূখণ্ডে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আমাদের কাছ সব ধরনের সমরাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিসের অভাব ছিল আর তা হলো ঈমানি শক্তি।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রইল।#

 

ট্যাগ