নভেম্বর ২১, ২০২৩ ১৭:৩৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বাধানো ও বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরানে গত বছরের সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা পেন্টাগন ও দেশটির গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বলব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর পশ্চিমা বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইরান পরিস্থিতির ওপর গভীরভাবে নজর রাখতে শুরু করে। এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নীতিকৌশল প্রণয়ন করা। এসব থিংক ট্যাংকের শীর্ষে ছিল আটলান্টিক কাউন্সিল নামক একটি প্রতিষ্ঠান। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে এই প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে। এটি ২০২১ সালের শেষদিকে ইরানের তরুণ ও যুবসমাজের ওপর বিশেষভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। এই প্রজেক্টের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক হলি ড্যাগরেসকে। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন ড্যাগরেস। তিনি ইরানি তরুণ ও যুব সমাজের ভার্চুয়াল এক্টিভিটি নিয়ে কাজ করতে করতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এসব তরুণের একটি অংশকে কাজে লাগিয়ে ইরানে দাঙ্গা ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।

এছাড়া, ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নারী ফারিবা পারসাসহ আরো কিছু গবেষক মিলে একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।  ফারিবা ওয়াশিংটনের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক।  গত মার্চ মাসে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের পরবর্তী বিপ্লব করবেন দেশটির নারীরা। এসব গবেষক ইরানের জাতিগত, ভাষাগত ও মাজহাবগত সংখ্যালঘুদের নিয়েও বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। গত এক বছরে ইরানের ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভিত্তি করে এসব গবেষণা করা হয়েছে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আমেরিকায় এ ধরনের যেসব গবেষণা হয় তা ইরানের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা পেন্টাগনের দীর্ঘমেয়দি পরিকল্পনার আওতায় করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে যে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছিল তার পেছনে এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

ইরানের সাম্প্রতিক দাঙ্গার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, ওই দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রধান যে হাতিয়ার ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়া। এসব খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পশ্চিমা গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর গত বছরের ওই দাঙ্গা শুরু হয় ইরানের নারী সমাজকে কেন্দ্র করে। হিজাব আইন অমান্য করার দায়ে পুলিশের হাতে আটক মাহসা আমিনি নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনাকে দাঙ্গা বাধানোর কাজে উপজীব্য করা হয়। প্রথম যখন তার মৃত্যুর খবরকে রঙ লাগিয়ে টুইটারে প্রকাশ করা হয় তখন কেউ কল্পনাও করেনি যে, এই একটি খবরকে ব্যবহার করে এভাবে সারা ইরানে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। টুইটার ব্যবহারকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে ওই খবরের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। এরপর সৌদি টাকায় পরিচালিত নিউজ চ্যানেল ইরান ইন্টারন্যাশনাল ও ব্রিটিশ সরকারের অর্থে পরিচালিত বিবিসি ফার্সি এ ব্যাপারে ইরানি জনগণকে উস্কানি দিতে এগিয়ে আসে।

ওই দুই চ্যানেলের উদ্যোগে ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে মাহসা আমিনি নামের হাশট্যাগ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। টুইটার ও ইনস্টাগ্রামের যেসব একাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত উস্কানি দেওয়া হয় সেসব একাউন্টের বয়স কয়েক দিন থেকে কয়েক মাসের বেশি ছিল না। ইরানি তরুণ সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার জন্য মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মিথ্যাচার করা হয়। তাদের প্রচারণার পক্ষে ভুয়া সিটি স্ক্যান রিপোর্ট, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মিথ্যা বিবৃতি এবং নিউরোলজি বিশেষজ্ঞদের ভুয়া বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। তারা সবাই একটি সুনির্দিষ্ট প্রচারণা তত্ত্বের ভিত্তিতে একথা বলতে থাকেন যে, পুলিশি নির্যাতনে মাহসা আমিনির মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ইরানের ফিল্ম জগতের সেলিব্রেটিরা দাঙ্গাকারীদের পক্ষে উস্কানি দিতে এগিয়ে আসেন। এরপর প্রাথমিক ভুয়া খবরগুলোর সঙ্গে আরো কিছু মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দাবি করা হয়, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আরো কিছু তরুণী নিহত হয়েছে।

এর আগে ২০০৯ সালে নেদা আগাসুলতানি নামের এক তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করেও একই ধরনের দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য কঠিনতম কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

২০২২ সালের ১ অক্টোবর ব্রিটিশ ওয়েবসাইট ক্র্যাডেলে সেদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক কিট ক্ল্যারেনবার্গের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যার নাম ছিল ‘পেন্টাগনের ইরানবিরোধী ভার্চুয়াল যুদ্ধের রহস্য উন্মোচন।’ ওই নিবন্ধে তিনি একথা তুলে ধরেন যে, ইরানের সাম্প্রতিক দাঙ্গায় দেশের বাইরে থেকে উস্কানি দেয়া হয় ও বাইরে বসে ওই দাঙ্গা পরিচালনা করা হয়। তিনি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে একথা দেখানোর চেষ্টা করেন যে, আমেরিকায় বসে একটি বোতাম টিপলে কীভাবে তেহরানের রাজপথে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানে দাঙ্গার সূত্রপাত হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, পেন্টাগনের নির্দেশে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন বাহিনী সেন্টকম ইরানবিরোধী দাঙ্গা পরিচালনা করছে।

‘গ্রাফিকা’ ও ‘স্ট্যানফোর্ড ইন্টারনেট অবজারভেটরি’ নামক দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ৫৫ পৃষ্ঠার এক যৌথ গবেষণায় ইরানের ভার্চুয়াল স্পেসসহ সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলিতে পেন্টাগনের ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলির কার্যকারিতা পর্যালোচনা করেছে৷ এই গবেষণা অনুসারে, ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি গোপন নেটওয়ার্ক কাঠামো তৈরি করা হয়, যাতে ইরানের অভ্যন্তরে জনমত পরিচালনা করার জন্য কয়েক ডজন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার ব্যবহারকারী সমন্বিতভাবে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। যখন একটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অস্থির থাকে তখন সেখানে ভুয়া খবর দ্রুত ছড়ায় এবং ওই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে।  মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও জীবিকা নিয়ে মানুষ সংকটে থাকার কারণে পেন্টাগনের নেতৃত্বে পরিচালিত ভুয়া খবরগুলো সাধারণ মানুষ দ্রুত বিশ্বাস করতে থাকে।

ভুয়া খবরের ধরনই হচ্ছে তা বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং যারা এ ধরনের খবর শোনে তারাই আবার তা ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু এ ধরনের খবরের সত্যতা প্রমাণিত হতে কয়েক দিন বা অনেক সময় কয়েক মাস সময় লেগে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের ভুয়া খবর ছড়িয়ে দিয়ে সমাজের যে ক্ষতি করা হয় প্রকৃত বাস্তবতা প্রচার করার মাধ্যমে কি তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব? অন্য কথায়, যারা ভুয়া খবর শুনে উত্তেজিত হয়েছিল তাদের সবার কানে কি প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরা সম্ভব? স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর ‘না’।  তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুগ যুগ ধরে বিশ্বের স্বাধীনচেতা দেশগুলোর সরকার ব্যবস্থা উৎখাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে।  হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ব্যবহার করে যে কাজ না হয় তা ভার্চুয়াল জগতে ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে করে যাচ্ছে পেন্টাগন।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, আজকের মতো এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

ট্যাগ