নভেম্বর ৩০, ২০২৩ ১৬:১৭ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-৫)

গত আসরে আমরা গত বছরের দাঙ্গার সময় ইরানে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে উস্কে দিয়ে কীভাবে এ দেশটিকে খণ্ড-বিখণ্ড করার চেষ্টা করা হয়েছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে শুরু করা ইসলামবিদ্বেষ ও ইরানবিদ্বেষ দিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানের জনগণ ১৯৭৯ সালে একজন প্রজ্ঞাবান আলেম অর্থাৎ ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ধর্মের ভিত্তিতে একটি বিপ্লব করে। ওই বিপ্লবের ফলে বিশ্বের বড় বড় সেক্যুলার চিন্তাবিদরা থ মেরে যায়। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে ইরানের মতো যে সমাজটিকে চরম পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছিল সেখানে একটি ইসলামি বিপ্লব ছিল তাদের কল্পনারও বাইরে। সেই ১৯৮০’র দশক থেকে শুরু করে এই বিপ্লব এখন পর্যন্ত সফলভাবে তার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাচ্ছে। ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন: বিপ্লবের পথচলায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলেও এটির মূল চরিত্র অক্ষুণ্ন রয়েছে। আর বিপ্লবের এই মৌলিক চরিত্রের কারণে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিপ্লবের শত্রুরা ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে যাচ্ছে।

দুই মেরুকেন্দ্রীক বিশ্বব্যবস্থার পতনের পর অবশিষ্ট একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। কারণ, তাদের সামনে শত্রুতা করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো কোনো আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না।  এ অবস্থায় মার্কিন চিন্তাবিদরা একথা বলতে থাকেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সামনে শত্রুতা করার জন্য কমিউনিজমের স্থলাভিষিক্ত হয় ইসলাম। মার্কিন আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য কিছু চিন্তাবিদ পেন্টাগনি দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জোসেফ নাই (Joseph Nye), জেইন শার্প (Gene Sharp), ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা (Francis Fukuyama)  এবং স্যামুয়েল হান্টিংটন (Samuel  Huntington)।  চার জনই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী এবং রকফেলার, ফোর্ড ও কার্নেগি ফাউন্ডেশনের সিনিয়র গবেষক।

তারা যে রাজনৈতিক মতবাদ উপস্থাপন করেন তা একবিংশ শতাব্দিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি-অবস্থানের ভিত্তিতে পরিণত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, হান্টিংটন সেইসব চিন্তাবিদের একজন যারা ১৯৯৩ সালে সভ্যতার সংঘর্ষের তত্ত্বে বিশ্বকে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভক্ত করার কথা বলেছিলেন। হান্টিংটন মুসলিম সভ্যতাকে পশ্চিমা সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে মূল্যায়ন করেন।

ইসলাম ধর্ম পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামী সংস্কৃতি মানবিক মর্যাদা ও ধর্মীয় মানবিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী শিক্ষা অত্যাচারকে মেনে না নেওয়া এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।

ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসান জোরেক বলেন: ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা শাসকদের অনেক উদ্বেগ রয়েছে কারণ যেকোনো জাতির স্বাধীনতার পক্ষে ইসলামের অবস্থান এবং এই ধর্ম নিজের হাতে জাতির ভাগ্য নির্ধারণের পক্ষে।  ইসলাম ন্যায়বিচারের ধর্ম এবং মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন জুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং নিষ্ঠুরতা এড়ানোর বিষয়টি রয়েছে। যারা জাতিগুলোর অধিকার লঙ্ঘন করে বিশ্ব শাসন করতে চায় তাদের জন্য এই দুটি বিষয় মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।

ইরানের বিপ্লব না প্রাচ্য, না পাশ্চাত্য বরং ইসলামি প্রজাতন্ত্র- এই স্লোগানের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচ্যের কমিউনিজম বা পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ কিংবা এই দুইয়ের সম্মিলনে তৈরি যেকোনো মতবাদ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রত্যাখ্যান করে। ইসলামের উপর নির্ভর করে ইরানের জনগণ দেখিয়েছে যে, বিপ্লবী আন্দোলনে তাদের স্বাধীন মূল্যবোধ ও নীতি রয়েছে এবং চিন্তাশীল ও স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য তারা একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশিষ্ট মার্কিন চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি মনে করেন, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর শত্রুতা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষের মূল কারণ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের সামনে ইরানের নতজানু না হওয়া।  তিনি আরো বলেন, ইরান যতদিন পাশ্চাত্যের সামনে আত্মসমর্পণ না করবে ততদিন এই শত্রু তা চলবে। আমেরিকার দৃষ্টিতে ইরানকে মেনে নেওয়া সম্ভভ নয় কারণ, দেশটি নিজের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষ করতে রাজি নয়।

ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমা আধিপত্যকামী দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা ইরানের পক্ষ থেকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এসব সমস্যার প্রধান দিক হচ্ছে, ইরানের পক্ষ থেকে পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। সেইসঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের পর জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষা শিল্পসহ সকল খাতে ইরানের চোখ ধাঁধানো সাফল্য মুসলিম দেশগুলোতে এই আশার সঞ্চার করেছে যে, আধিপত্যকামী শক্তিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করে স্বাধীনচেতা দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে টিকে থাকা সম্ভব।

মর্টন এ. কাপলানের মতো আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, ইরান মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একমাত্র দেশ যার মধ্যে পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের যোগ্যতা রয়েছে। কারণ, ইরান নামক ভূখণ্ডটি কয়েক হাজার বছর ধরে একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের বাকি দেশগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর গঠিত হয়েছে। কিন্তু ইরান ঐতিহাসিকভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ইরান নামেই পরিচিত ছিল। ইহুদিবাদী ইসরাইল ইরানের এই বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আমেরিকা ও ব্রিটেনও তা ভালো করে জানে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে ইরানকে কাবু করা সম্ভব নয়। এ কারণে ইরানকে দুর্বল করার একমাত্র উপায় হিসেবে তারা দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক চাপ ও প্রচারণা যুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে।

ইরানের শক্তিশালী হয়ে ওঠার যেসব কারণ এতক্ষণ বললাম অর্থাৎ ইসলাম, বিপ্লব ও ইরান- এর যেকোনো একটি একাই আমেরিকা ও তার মিত্রদের শত্রুতার কারণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আধিপত্যকামী শক্তিগুলো বহু বছর ধরে এই খাতে বিশাল অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। তারা একদিকে যেমন জাতিসংঘের অপব্যবহার করেছে তেমনি আল-কায়েদা ও আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী সৃষ্টি করে মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ও ইরানবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও অনন্য।

পশ্চিমা দুনিয়া গণমাধ্যমের শক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। তারপরও গণমাধ্যমে কোনো ঘটনা তাৎক্ষিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং সকলে সহজেই একথা বুঝতে পেরে যায় যে বাস্তবতা কি। কিন্তু হলিউডি সিনেমাগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিজস্ব স্টাইলে বিকৃত করে তুলে ধরা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের স্বরূপ যতটা সম্ভব চেপে যাওয়া য়ায় এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ইতিবাচক দিকগুলোকে উপেক্ষা করে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা তুঙ্গে উঠানো সম্ভব।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ