নভেম্বর ৩০, ২০২৩ ২০:২৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণমাধ্যমলোর দ্বৈত আচরণ নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইরানের নারী সমাজের যে চিত্র তুলে ধরা হয় তা নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইরানে গত বছর যে দাঙ্গা হয়েছিল তা শুরু করা হয়েছিল ইরানের নারী অধিকার রক্ষা করার অজুহাতে। মাহসা আমিনি নামের এক নারী হিজাব পরিধান না করায় পুলিশের হাতে বন্দি হয় এবং বন্দি অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাকে পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর উস্কানিতে বহু নারী ও তরুণী হিজাব পরিধান না করেই রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তারা হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করে ইরানে যে আইন রয়েছে তা বাতিল করার দাবি জানায়।

অবিশ্বাস্যভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা একযোগে ও ব্যাপক সমন্বয়ের মাধ্যমে ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে টার্গেট করে সহিংসতাকে উস্কানি দিতে থাকে। তবে সব মার্কিন রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাই যে সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছিলেন তা নয়। মার্কিন কমেডিয়ান ওয়েন বেঞ্জামিন তার অফিসিয়াল টুইটার পেজে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস শহরের একটি পতিতালয়ের সামনে টানিয়ে রাখা একটি ব্যানারের ছবি প্রকাশ করেন। ওই ব্যানারে ইরানে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী নারী মাহসা আমিনির ছবি ছিল এবং ইরানে সহিংসতাকারীদের পক্ষে কিছু স্লোগান লেখা ছিল। বেঞ্জামিন ওই ছবি প্রকাশ করে তার টুইটার পেজে ইরানি নারীদের উদ্দেশ করে লিখেছেন: “আপনারা ওদের স্লোগানে কান দেবেন না। ওরা আপনাদের মাথা থেকে হিজাব কেড়ে নিয়ে আপনাদেরকে মাদকাসক্ত পতিতা বানাতে চায়। তারা আপনাদের স্বাধীনতার ধুয়া তুলে আপনাদের পারিবারিক নিরাপত্তা ও সম্মান কেড়ে নিতে চায়। ইসলামের শরিয়ত আপনাদের প্রতি অবিচার করেনি বরং আপনাদের রক্ষা করেছে।”

গত বছরের দাঙ্গার সময় ইরানের নারী সমাজের প্রতি কথিত সংহতি জানিয়ে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ নামের একটি স্লোগান ব্যাপকভাবে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি জার্মানি, কানাডা, সুইডেন, বেলজিয়াম ও স্পেনের মতো পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের দাঙ্গাকারীদের সমর্থন জানাতে গিয়ে ওই স্লোগানের কথা উল্লেখ করে। যেমন, সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানা লিন্ড দাঙ্গার সময় ইরানের নারী সমাজের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য দেন। অথচ একই সময়ে ইরানির দুই নারী সুমাইয়া ও গাজাল তাদের সুইডিশ স্বামীদের হাত খুন হলেও অ্যানা লিন্ড সে বিষয়ে মুখে কুলুপ এটে থাকেন। এমনকি সুইডেনে দুজন ইরানি গৃহবধূ খুনের ঘটনা দেশটির গণমাধ্যমও ভালো করে প্রচার করেনি।

এদিকে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথেরিন কোলোনা ইরানে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসে লিপ্ত দাঙ্গাকারীদের অপতৎপরতাকে ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ’ বলে অভিহিত করেন এবং ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে বলেন, ইরানি শাসকদের এ ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সময় ইরানের দাঙ্গার প্রতি সমর্থন জানান যখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরনকে গালি দেওয়ায় ৫০ বছরের এক নারীকে প্যারিস সরকার বড় ধরনের শাস্তি দেয়। ওই নারীকে ‌১৩ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। অথচ ফ্রান্সের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রকাশনায় মুসলমানদের পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা করার জন্য কোনো শাস্তি হয় না বরং প্যারিস এ ধরনের অপতৎপরতাকে সমর্থন করে।

পশ্চিমা দেশগুলো এমন সময় ইরানের নারী স্বাধীনতার পক্ষ অবলম্বনকারী সেজেছে যখন ওইসব দেশের নারী সমাজ চরম নির্যাতনের শিকার এবং তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলালে দেখা যাবে, নারীর প্রতি অবিচার ও অবমাননা অতীতের মতোই অব্যাহত রয়েছে। টমসন রয়টার্স ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে নারীদের জন্য নিরাপত্তাহীন ১০টি দেশের তালিকায় আমেরিকার নাম রয়েছে।  ব্রিটেনের দিকে তাকালেও আমরা একই ধরনের চিত্র দেখতে পাবো। এই দেশটিতে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ বছরে প্রায় ১,৫০০ নারী সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ব্রিটেনে প্রতি তিন দিনে একজন করে নারী খুন হচ্ছেন। জার্মানিতে পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, শুধুমাত্র ২০১৮ সালে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে দেশটিতে ১২০ জন নারী নিহত হয়েছেন। ফ্রান্সে ২০‌১৯ সালে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে  নিহত ১৪৯ ব্যক্তির মধ্যে ১২১ জনই ছিলেন নারী।

পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী যখন এভাবে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার তখন এসব দেশ কেন একযোগে ইরানে দাঙ্গার সময় নারী অধিকারের প্রবক্তা হয়ে উঠল? এর উত্তর অতি সহজ। রাজনৈতিক কারণে তারা এ কাজ করেছে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব ফুয়াদ ইজাদি এ সম্পর্কে বলেন, ইরানি নারীদের অধিকারের প্রতি পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম যে সমর্থন ঘোষণা করে তা কোনো অবস্থায় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং রাজনৈতিক কারণে তারা এ সমর্থন জানায়।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তারা কোনো ঘটনা সম্পর্কে জনমনে এমন একটি চিত্র তৈরি করে যার সঙ্গে বাস্তবতার যোজন যোজন পার্থক্য রয়েছে। যেমন, তারা যখন হিজাব নিয়ে কথা বলে, তখন হিজাব পরিহিতা নারীদের বক্তব্য প্রচার করে না। হিজাব পরিহিতা নারীদের যুক্তি তারা তুলে ধরে না। তারা বরং হিজাব বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে এবং এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার জন্য বেপর্দা নারীদের সাক্ষাৎকার প্রচার করে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বিগত কয়েক দশক ধরে ইরানের নারী সমাজ সম্পর্কে পাঠক ও দর্শকদের জন্য এমন একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই। ইরানি সমাজের বাস্তবতা কী- সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিশ্ব জনমত এখন পশ্চিমা গণমাধ্যম থেকে ইরানের নারী সমাজ সম্পর্কে ‘সঠিক চিত্র’ পাওয়ার চেষ্টা করে। অথচ এসব পাঠকের অনেকে একথা জানেনই না যে, ভৌগোলিক দিক দিয়ে ইরানের অবস্থান কোথায়? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তারা ইরান সম্পর্কে জানুক আর না জানুক ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গ্রাজুয়েশন করা শিক্ষার্থীদের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নারী।  ইরানে বিশেষজ্ঞ নারীর অনুপাত ৯৮ শতাংশ হলেও আমেরিকায় এই অনুপাত মাত্র ৮৫ শতাংশ। ইরানে প্রতি ১০০ জন প্রসূতি মায়ের মধ্যে মাত্র ৭ জন মৃত্যুবরণ করেন অথচ আমেরিকায় এই সংখ্যা ২৩ জন। ইরানে নারী চিকিৎসকের হার শতকরা ৪০ জন অথচ আমেরিকায় এই হার শতকরা ৩৪ জন। ইরানি মাতৃত্বকালীন ছুটি ৯ মাস হলেও আমেরিকায় এ ধরনের কোনো ছুটি নেই।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ