ডিসেম্বর ১৩, ২০২৩ ১৯:২৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজকের আসরে আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: তড়িঘড়ি কাজের জন্য অভিশাপ। মজার এই প্রবাদটির পেছনে রয়েছে হাস্যরসাত্মক একটি গল্প। 

গল্পটি এরকম: এক নব দম্পতি। সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে তাদের। ভালোই কাটছে তাদের দিনকাল। দু'জনেরই আশা সন্তানের বাবা-মা হবার। এরইমাঝে একদিন বৌ তার স্বামিকে বললো: জানো! তুমি কিন্তু অচিরেই বাবা হতে যাচ্ছো! তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। বাচ্চার জন্য দোলনা লাগবে, জামা-কাপড় লাগবে, লেপ-তোষক লাগবে, আরও অনেক কিছু লাগবে। আস্তে আস্তে আমাদের এগুলো সংগ্রহ করা ভালো। স্বামি তো বাবা হবার কথা শুনেই প্রচণ্ডরকম খুশি হয়ে গেল। বৌ তার খুশি দেখে আরও খুশি হলো। 

পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্বামি সোজা চলে গেল বাজারে। লেপ-তোষক তৈরি করে যারা সেরকম বেডিং-এর দোকানে গেল সে। দোকানদারকে বাচ্চার জন্য লেপ এবং তোষক তৈরির অর্ডার দিলো। তারপর গেল টেইলার্সের কাছে। সেখানেও বাচ্চার জন্য কয়েক সেট জামা-কাপড় তৈরি করার কথা বললো। এরপর লোকটি কাঠমিস্ত্রির কাছে গেল। তাকে বললো: আমি ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি বাবা হতে যাচ্ছি। তো বাচ্চার জন্য একটা সুন্দর এবং আরামদায়ক দোলনা বানিয়ে দিতে হবে। মিস্ত্রি প্রশান্ত হাসি মুখে টেনে বললো: ইনশাআল্লাহ! অভিনন্দন তোমাকে। বাচ্চার জন্ম শুভ হোক। এমন দোলনা বানিয়ে দেবো যেরকম সুন্দর এবং আরামদায়ক দোলনা কেউ আর কখনও দেখে নি। তুমি শুধু বায়না হিসেবে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে যাও যাতে নিশ্চিন্তে কাজে হাত দিতে পারি। বাবা হতে যাবার আনন্দে লোকটি বায়না দিয়ে বাসায় ফিরে গেল।

বাসায় ফিরে বৌকে ডেকে বললো: আমাদের বাচ্চার জন্য যা যা প্রয়োজন সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। বৌ খুব খুশি হলো। এরপর দিন তিনেক অতিবাহিত হলো। তারপর থেকে প্রতিরাতেই যেখানে যে জিনিস তৈরি করতে দিয়েছিল সেখান থেকে একটি একটি করে জিনিস নিয়ে বাসায় ফিরতে লাগলো। একদিন বেডিং হাউজ থেকে লেপ নিয়ে ফিরলো। আরেকদিন তোষক নিয়ে। আবার একদিন বাচ্চার বিশেষ পোশাক-আষাক নিয়ে বাসায় এলো। বৌ প্রতিদিন তাদের সন্তানের জন্য আনা পোশাক-আষাক, জিনিসপত্র দেখে খুব খুশি হতো এবং প্রতিদিনই জানতে চাইতো: দোলনা কোথায়? দোলনা? আমাদের সন্তান তো দোলনা ছাড়া আরামে ঘুমোতে পারবে না। 

স্বামি বিষয়টা জানতো যে দোলনাটা খুব প্রয়োজন। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি সময়মতো কাজটা করে নি। প্রতিদিনই কাঠমিস্ত্রির দোকানে একবার করে যেত। সুন্দর করে খোজ-খবর নিয়ে বলতো: আমাদের বাচ্চার দোলনাটা কবে তৈরি হবে? মিস্ত্রিও হাসি দিয়ে বলতো: এতো অধৈর্য হয়ে কাজ নেই। দোলনা অবশ্যই তৈরি হবে। আমি চাচ্ছি তোমার জন্য সবচেয়ে সুন্দর এবং আরামদায়ক দোলনা বানাতে। ভালো কোনো জিনিস তাড়াতাড়ি তৈরি হয় না, সময় লাগে। আমি তড়িঘড়ি কোনো কাজ করি না। এভাবে কাঠমিস্ত্রির কথা অনুযায়ী কাজ না করার প্রবণতা অব্যাহত থাকে। এরইমাঝে বাচ্চার জন্ম হয়। বাবা দ্রুত মিস্ত্রির কাছে গিয়ে খবরটা দেয়। মিস্ত্রি আবারও মিষ্টি হাসি দিয়ে কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে: আমি তো বললাম দ্রুত কোনো কাজ করি না আমি।

মিস্ত্রি আরও বললো: তোমার বাচ্চার জন্ম তাড়াতাড়ি হলে আমার কী করার আছে? আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার দোলনা তৈরি করে দেবো। এভাবে মিস্তির কাছে বাচ্চার বাবার যাওয়া-আসা অব্যাহত থাকলো আর মিস্ত্রিরও কথা না রাখার পালা চলতে থাকলো। অগত্যা প্রতিবেশির দোলনায় বাচ্চা বেড়ে উঠলো এবং ধীরে ধীরে বড়ো হলো। দু'বছর বয়স এখন তার। বাচ্চা এখন কথা বলতে চেষ্টা করে,হাঁটতে চায়। দোলনার আর প্রয়োজন নেই বাচ্চার। বাবা মিস্ত্রির ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেল। তারপরও মাঝেমধ্যেই তার কাছে গিয়ে দোলনার ব্যাপারে জানতে চাইতো। এভাবে যেতে যেতে আমাদের গল্পের স্বামি-স্ত্রী এবং বাচ্চা বড় হয়ে গেল এবং সিদ্ধান্ত নিলো বাচ্চাকে বিয়ে দেওয়ার। 

যেই কথা সেই কাজ। পাত্রী পছন্দ হয়ে গেল এবং বিয়ে হলো। বছরখানেক পর বুঝতে পারলো যে তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চার জন্ম হবে। এই খবর সে তার বাবা-মাকে জানিয়ে বললো: এখন তো লেপ-তোষক আর দোলনা তৈরি করতে হবে। বাবা-মা দোলনার কথা শুনে বিশ বছর আগের সেই মিস্ত্রির কথা মনে পড়ে গেল। বাবা মিস্ত্রির কাছে গেল। সালাম দিয়ে বললো: ওস্তাদ! বিশ বছর আগে আমার বাচ্চার জন্য একটা দোলনার অর্ডার দিয়েছিলাম। বায়নাও দিয়েছিলাম কিছু। এখন এলাম খোজ নিতে-আমার সন্তানের দোলনাটা কি তৈরি হয়েছে নাকি হয় নি? আমার বাচ্চা তো দোলনা ছাড়াই বড় হয়েছে। এখন সে বিয়ে করেছে এবং তার বাচ্চার জন্য দোলনা দরকার।

মিস্ত্রি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছুটা বিরক্তিভরে আলমারি খুললো। কিছু টাকা ওই লোকের হাতে তুলে দিতে দিতে বললো: এই নাও তোমার বায়নার টাকা। অন্য কোনো মিস্ত্রির কাছে যাও! তোমার ছেলের দোলনা তৈরির অর্ডার দাও! আমি দ্রুত কাজ করতে পছন্দ করি না। ওই ঘটনার পর থেকে কেউ যখন তার ব্যক্তিগত অলসতার কারণে কোনো কাজ না করে কিংবা এমন সময় কাজটা করে যখন ওই কাজটার আর প্রয়োজন থাকে না, তখন ব্যঙ্গ করে এই কথাটি বলতে শোনা যায়: দ্রুত কাজের জন্য অভিশাপ।
পার্সটুডে/এনএম/১৩/১১৯

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ