অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-১৩)
আজকের আলোচনায় আমরা মুসলিম বিশ্বের সংস্কৃতি ও দর্শনের উপর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম ও ইরানী দার্শনিকের রচনাসামগ্রী ও এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো। ফারাবিকে ভালোভাবে জানার অন্যতম উপায় হলো তার যুগের সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক অবস্থা সম্পর্কে জানা।
মানব ইতিহাস জুড়ে, অনেক প্রতিভা এবং বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে মানুষের চিন্তার ইতিহাসে একটি বাঁক তৈরি করেছেন এবং তাদের যুগের সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা ও সামাজিক অঙ্গনে অসাধারণ পরিবর্তন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এইসব মনীষীরা বিজ্ঞান ও চিন্তা গবেষণার জগতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন এবং খোদা প্রদত্ত প্রতিভাকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। অনেকে বিরূপ পরিবেশে থেকেও তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। ফারাবি ছিলেন এমনই একজন ব্যক্তি।
ফারাবি ছিলেন এই প্রতিভাবানদের মধ্যে একজন যিনি ইতিহাসের অত্যন্ত সংবেদনশীল বা স্পর্শকাতর সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং পরবর্তী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফারাবির প্রভাব এতোটাই বেশি ছিল যে বলা যায়, ফারাবি এবং তার চিন্তাধারা মুসলিম সভ্যতার বিকাশের ভিত্তি প্রদান করেছিল। আবু নসর মুহাম্মদ বিন তাহান ফারাবি, যিনি "দ্বিতীয় শিক্ষক" নামে পরিচিত।
ফারাবি এ্যারিস্টটলের দর্শনচর্চায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় এ্যারিস্টটলের গ্রন্থাবলীর ওপর তাঁর ভাষ্য রচনায়। তাঁর টীকা-ভাষ্যগুলো অতি উচ্চমানের। এ ভাষ্যগুলো পরবর্তীকালের গ্রীক দার্শনিক মতবাদসমূহের ধারা বজায় রাখে। এসব টীকা-ভাষ্যগুলোর একটি সংকলন সাম্প্রতিককালে মূল্যবান ও বিশাল কলেবরে সম্পাদিত হয়েছে। এ্যারিস্টটলের অর্গানন, ফিজিক্স এবং নিকোম্যাকিয়ামন এথিক্স-এর ওপর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে।
ওপরোক্ত গ্রন্থ ছাড়াও আল-ফারাবীর বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে উল্লেখ করা হল। যুক্তিবিদ্যার ওপর তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, আত-তাওতি আ ফিল-মানতিক, কমেন্টারী অন অ্যানালাইটিকা পোস্টেরিয়া, কমেন্টারী অন-অ্যানালাইটিকা প্রিওয়া, কমেন্টারী অন দি ইসাগোগ, কমেন্টারী অন টপিকা, কমেন্টারী অন সফিস্টিকা, কমেন্টারী অন দি ইন্টারপ্রেটেশান, কমেন্টারী অন দি ক্যাটেগরিয় এবং 'আশশের'। এ গ্রন্থগুলো ছাড়াও যুক্তিবিদ্যার ওপর তাঁর আরও চিন্তাগবেষণা ও মতামত আছে।
এ ছাড়া, পদার্থবিদ্যার ওপর ফরাবির লিখিত গ্রন্থের মধ্যে যেসব গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে অন ভাক্যুয়াম এবং ফিল আকল বা ডি ইনটেলেক্ট। এগুলো তুর্কী, ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অধিবিদ্যার ওপর ফরাবির প্রধান গ্রন্থ হচ্ছে 'ফিল ওয়াহিদ ওয়াল ওয়াহাদ' বা অন দি ওয়ান এবং অ্যাবাউট দি ইস্কপ অব এ্যারিস্টটল মেটাফিজিক্স। জার্মান এবং ইংরেজী ভাষায় এগুলো অনূদিত হয়েছে।
নীতিশাস্ত্রের ওপর তাঁর প্রধান গ্রন্থ হচ্ছে, আত তানবীহ আলা সাবিলিস সা'আদা বা রিমাইনডার অব দি ওয়ে অব হ্যাপিনেস। এটি মধ্যযুগে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ফুসলুল মাদানী বা 'অ্যাফোরিজমস অব দি স্টেটসম্যান' তাঁর আরেকটি গ্রন্থ। এটি ল্যাটিন ভাষায় টীকাসহ অনূদিত হয়েছে। 'ফিল মিল্লা আল ফাদিলা' বা 'অন দি বেস্ট রিলিজিওয়ন' তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
এ ছাড়া, রাষ্ট্রদর্শনের ওপরও তাঁর গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। এ বিষয়ে তাঁর লিখিত যেসব গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে, আল-মদিনাতুল ফাযিলাহ বা আদর্শ রাষ্ট্র, সিয়াসাতুল মাদানিয়া বা নগর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, আরাউয়াল আহলিল, জাওয়ামিনুস সিয়াসত, ইজতিমাউ মাদানিয়াত।
তবে, রাষ্ট্রদর্শনের ওপর উল্লেখিত এসব গ্রন্থগুলো ছাড়াও প্লেটোর 'রিপাবলিক' এবং এ্যারিস্টটলের 'দি পলিটিকস' গ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্য তিনি রচনা করেন।
আল-ফারাবি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশ করে গ্রন্থ রচনা করেছেন। অন্যান্য বিষয়ের ওপর যেসব গ্রন্থ রচনা করেন সেগুলো হচ্ছে, আল-জাম বায়ানার রায়ায়ি আল-হাকিম আফলাতুন আল-ইলাহি ওয়া আরিসতুতালিস যা কিনা জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া, ফুসুস আল-হিকাম জার্মান ভাষায় এবং কিতাব ইহসাইল উলুম বা বিজ্ঞান সমূহের জরিপ গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আরো একটি গ্রন্থ হচ্ছে 'অন দি ফিলসফি অব এ্যারিস্টটল যা কিনা এ্যারিস্টটলের দর্শনের ওপর।
উপরে উল্লিখিত গ্রন্থ ছাড়াও আল-ফারাবীর আরও অনেক গ্রন্থের পরিচয় ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থে আল-ফারাবীর গবেষণা ও সমীক্ষার ফলাফল ও তাঁর সুদূরপ্রসারী মনোভাবের সারাংশ ও সারমর্ম নিহিত আছে। এই গ্রন্থগুলো রচনার মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্য ছিল চিন্তাজগতে ও নিখুঁত সমাজ গঠনে দর্শনকে সার্বভৌম অবস্থান দান করা।
আবু নসর আল-ফারাবি বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন একদিকে গণিতবিদ এবং অন্যদিকে পদার্থবিদ। আবার তিনি যুক্তিবিদ এবং দার্শনিক হিসেবে অনেক পরিচিত। সেকালের প্রচলিত ভাবধারা অনুযায়ী তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। কিন্তু চিকিৎসাকে কখনও পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর দীর্ঘকালের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে অঙ্কশাস্ত্রের মত কঠিন বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা প্রদান করেন। মধ্যযুগের যুক্তিবিদদের মধ্যে তিনি নিঃসন্দেহে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সামগ্রিকভাবে তাঁর দর্শনের মধ্যে যুক্তিবিদ্যা এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। তিনি পরিণত বয়সে দার্শনিক চিন্তাধারায় মনোনিবেশ করেন বলে তাঁর দর্শনের মধ্যে তাঁর নিজস্ব ভাবধারা স্পষ্ট।
অন্যান্য শাস্ত্রের মতো আল-ফারাবি অঙ্কশাস্ত্রেও একজন পণ্ডিত ছিলেন। গাণিতিক নিয়মে চিন্তাধারা প্রকাশের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর চিন্তাধারার সর্বত্রই। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আলোচনায় এমনকি ব্যবহারিক দর্শনেও অংকের উদাহরণ দিয়ে চিন্তাধারা প্রকাশের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূচনা করেন। আল-ফারাবী অঙ্কশাস্ত্রকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করেন। এই বিভাগগুলো হচ্ছে, গণিতবিদ্যা, জ্যামিতি, সমস্যার বিভিন্ন দিকের আপাতসংযোগ বিদ্যা, জ্যোতি:শাস্ত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞান, মিউজিক, গতিবিদ্যা, বলবিদ্যা। তাঁর মতে বিজ্ঞানের দু'টি অংশ আছে। এর একটি তাত্ত্বিক এবং আরেকটি ব্যবহারিক।
প্রতিটি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ দু'টি বিভাগ নির্ভর করে বিজ্ঞানের নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার ওপর। আবার কলা বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ দু'টি অংশ নির্ভর করে এদের প্রয়োগের ওপর। তিনি উদাহরণস্বরূপ তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা বলেন।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।