ডিসেম্বর ২৪, ২০২৩ ১৭:২০ Asia/Dhaka
  • ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযানের ফলাফল -(পর্ব-১)

পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ই অক্টোবর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনে, ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস-এর যোদ্ধারা দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরে সফল হামলা চালায় যা ইসরাইলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের ঘটনা।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এই পরাজয়কে 'অপূরণীয় পরাজয়' বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস, হামাসের সাম্প্রতিক আল আকসা তুফান অভিযান ও এর ফলাফল এবং গাজার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক পর্বে আমরা আলোচনা করবো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব দুই মেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো পুরোনো শক্তিধরগুলো দ্বিতীয় স্তরের শক্তিতে পরিণত হয় এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে দুই মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা চালু হয়। এমতাবস্থায় ব্রিটেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের বিষয়টি উত্থাপন করে এবং অনেক চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এই প্রস্তাব অনুসারে, ইহুদিরা, যারা এর আগে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ ছিল, তারা ফিলিস্তিনি ভূমির প্রায় ৫৫ শতাংশ লাভ করেছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা, জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ হলেও তাদেরকে দেয়া হয় মাত্র ৪৫ শতাংশেরও কম ভূমি। এ কারণে এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনি ও মুসলিম দেশগুলো তখন মেনে নেয়নি এবং এর প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনে সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি অর্জন করে এবং এরপর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে চলে যাওয়ার পর ইহুদিরা 'ইসরাইল' রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় আরব ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং  প্রথম ইসরাইলের সাথে আরবদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওই যুদ্ধে ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ পশ্চিমতীর জর্ডানের সাথে এবং গাজা উপত্যকা মিশর সীমান্তের সাথে রয়ে যায়।

৮ বছর পর, ১৯৫৬ সালে, দ্বিতীয় দফায় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ ইসরাইল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিশর আক্রমণ করে এবং এর উদ্দেশ্য ছিল সুয়েজ খালের উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠিত করা এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কিন্তু ওই যুদ্ধে ইসরাইল, ব্রিটেন ও ফ্রান্স জোট পরাজিত হয় এবং মিশর সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করে, আর জামাল আবদুল নাসের হয়ে ওঠে আরব বিশ্বের নায়ক।

এরপর ১৯৬৭ সালে সংঘটিত হয় তৃতীয় যুদ্ধ, যা আরব-ইসরাইলের মধ্যকার ৬ দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ওই যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরব দেশগুলোর পরাজয় ঘটে। কারণ আমেরিকা ও ইউরোপের অস্ত্র সহায়তা নিয়ে ইসরাইল ৬ দিনের যুদ্ধে পশ্চিমতীর, গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং মিশরের সিনাই উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল। এর ফলে ইসরাইলের আয়তন তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পায়। এর ৬ বছর পর, মিশরের আনোয়ার সাদাত, সিরিয়ার হাফিজ  আল-আসাদ এবং জর্ডান সরকার ১৯৭৩ সালে একটি আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে তাদের দখলকৃত ভূমিগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালায় কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। সর্বশেষ ওই যুদ্ধে মিশর পরাজিত হওয়ায় আনোয়ার সাদাত আমেরিকার মধ্যস্থতা মেনে নিয়ে সিনাই উপত্যকা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সই করতে বাধ্য হন। ক্যাম্প ডেভিড আপোষ চুক্তির ফলে মিশর ইসরাইলের বিরোধিতা করা থেকে সরে আসে এবং বিনিময়ে সিনাই উপত্যকা ফিরে পায়। এইভাবে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের অবসান ঘটে।

এরপর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। আরব দেশগুলোর সেনাবাহিনী ১৯৭৩  সালের যুদ্ধে ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হলেও, ২০০০ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইসরা‌ইলি সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ লেবানন থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। ২০০৫ সালে দখলদার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আরেকটি পরাজয় ঘটে। ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় গণজাগরণ বা ইন্তিফাদা আন্দোলন শুরুর পাঁচ বছর পর, ইসরাইলি সেনারা ৩৮ বছর পর গাজা উপত্যকা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় যা ছিল ইসরাইলি বাহিনীর দ্বিতীয় পরাজয়ের ঘটনা। ইসরাইলের তৃতীয় পরাজয় ঘটে ২০০৬ সালে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ৩৩ দিনের যুদ্ধে। এর ফলে ইসরাইল অপরাজেয় শক্তি বলে এতদিন ধরে যে প্রচারণা চালানো হতো তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সর্বশেষ চতুর্থ এবং বলা যায় সবচেয়ে বড় পরাজয়টি ঘটে চলতি বছর গত ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের মধ্য দিয়ে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস যোদ্ধাদের আল-আকসা তুফান অভিযান ছিল গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। আশুন এবারে আমরা জানার চেষ্টা করবো কেন এটি ইসরাইলের জন্য নজিরবিহীন পরাজয়ের ঘটনা ছিল।

প্রথমত, হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযানে ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। একযোগে হামাসের আকাশ, স্থল, সমুদ্র ও সাইবার হামলা ছিল একথায় বিস্ময়কর যা ইসরাইলকে হতচকিত করে দিয়েছে।  ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের দখলিকৃত ভূখণ্ডের গভীরে প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলন সফল অভিযান চালায়। এসময় তারা ইসরাইলের ২২টি শহর এবং দশটিরও বেশি সামরিক ঘাঁটিতে হানা দেয় এবং ইসরাইলের বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অন্যান্য সরঞ্জাম ধ্বংস করে দেয়। একইসাথে তারা ২০০ জনেরও বেশি লোককে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসে যাদের মধ্যে বহু ইসরাইলি সেনাও রয়েছে। এ ঘটনা থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ শক্তি এবং ইসরাইলের সামরিক, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। ২০২১ সালে সাইফ আল-কুদস অভিযানের পর, প্রতিরোধ বাহিনী দুই বছর ধরে আল-আকসা তুফান অভিযানের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অনুশীলন করেছিল।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ একেবারেই অসম যুদ্ধ। আমেরিকার সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা নিয়ে ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে বর্বরতা ও শক্তিমত্ত্বা দেখিয়ে আসছে। অন্যদিকে, সেই তুলনায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা সব দিক থেকেই অত্যন্ত দুর্বল এবং ইসরাইলের শক্তির সাথে তাদের কোনো তুলনাই চলে না। কিন্তু যে বিষয়টি হামাসকে জয়ী করেছে ও সবাইকে হতবাক করেছে তা হল ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিরোধ শক্তির আত্মবিশ্বাস, অন্তর্দৃষ্টি এবং প্রস্তুতি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেছেনে, আল-আকসা তুফান অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে, প্রতিরোধ যোদ্ধারা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে খুব কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দৃঢ় সংকল্পের সাথে একটি ছোট দল নিয়ে বড় শত্রুকে মোকাবেলা করা যায়।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ